সুকুমার সরকার

মাহুর কিসমত

। এক ।
বখতিয়ারের মাজারটিই বুড়া পীরের মাজার । বৃদ্ধ বোরহান উদ্দিন শা’ফকির দীর্ঘদিন থেকে চারশো টাকা মাইনের খাদেম । তাঁর বাবা আমজাদ আলী শা’ফকিরের মাইনে ছিল পঞ্চাশ টাকা । আমজাদ আলী শা’ফকিরের মৃত্যুর পর বোরহান উদ্দিন শা’ফকির অফিসিয়ালি দায়িত্ব নিতে গেলে ওয়াকফ বোর্ড মাইনে বাড়িয়ে চারশো টাকা করে দিয়েছে ।

চারশো টাকা মাইনের খাদেমের প্রতিদিন মাজার গিয়ে ঝাড়-ঝাটা দিয়ে আসার কথা । খোলা ছাদের মাজারের ভিতরে প্রতিদিন বখতিয়ারের কবরের ওপর মাটির পিদিম আর একটি দু’টি মাটির ঘোড়া সাজিয়ে আসার কথা । কিন্তু বৃদ্ধ বোরহান উদ্দিন শা’ফকির তা করেন না । সপ্তাহে একদিন কিংবা দু’তিন সপ্তাহ পরে একদিন গিয়ে মাজার পরিস্কার করে মাটির ঘোড়া সাজান আর পিদিম জ্বালিয়ে আসেন । সে পিদিম খাদেমের মাজার থেকে বেরোবার আগেই নিভে যায় ! খাদেম পিছনে ফিরে তাকান না । চারশো টাকা মাস মাইনেই এরচেয়ে বেশি আর কী করা যায় ? তারপরেও বছরে একবার বকরি কুরবানি দিতে হয় । নিজের বাড়ির বকরিই কুরবানি দেন বোরহান উদ্দিন । কিনে দেবার টাকা ওয়াকফ বোর্ড দেয় না ।

প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার বকরি কুরবানি দিয়ে ছিন্নি রান্না হয় । গ্রামের সকলে এক সঙ্গে বসে ছিন্নি খায় । তারপর শুরু হয় একমাস ধরে মেলা । ওই একমাস প্রতিদিন মাজার পরিস্কার করতে হয় । প্রতিদিন মাটির ঘোড়া সাজাতে হয় । প্রতিদিন মাটির পিদিম জ্বালাতে হয় । মাটির ঘোড়া আর মাটির পিদিম স্থানীয় কুমোররা জোগান দেন । ছিন্নির চাল, তেল গ্রামের মানুষই দেন । তবে ওই একমাস খাদেম বোরহান উদ্দিন শা’ফকিরকে মাজারের পাশেই থাকতে হয় । তাঁর বাড়ি মাজার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে আতাশা’র দরগার পাশে । আতাউল্লাহ শা’ফকিরের মুরিদ বোরহান উদ্দিন শা’ফকিররা । মাইনে যাই হোক , মাজারের খাদেমগিরি করাকে তাঁরা পবিত্র ধর্মীয় বিধি মনে করেন ।

একমাসের মেলায় প্রতিদিন হিন্দু-মুসলমান কত লোক আসেন । সকলেই মাজারে প্রদীপ জ্বালান । ঘোড়া সাজান । হিন্দু নারীরা প্রথমে মাজারের পাশে একটি ভগ্ন পাথরে সিঁদুর চড়ান । তারপর মাজারে এসে প্রদীপ জ্বালান । খাদেম বাইরে টুল নিয়ে বসে থেকে সবাইকে বলেন, জুতা খুলে যান । ইদানিং বাইরে থেকে লোকজনও আসেন । খবরের কাগজে খাদেমের ছবি সহ খবর ছাপা হয় । টুলে বসে কখনো কখনো খাদেম বোরহান উদ্দিন শা’ফকির খবরের কাগজে মাজারের ছবির পাশে নিজের ছবি দেখেন ।

মাজারের পাশে টলটলে জলের একটি পুকুর আছে । পুকুরটিও মাজারের সম্পত্তি । কিন্তু লিজের টাকা নিয়ে যায় ওয়াকফ বোর্ড । খাদেম বোরহান উদ্দিন শুধু পুকুরের জল পান করেন । এটাই নিয়ম । একমাস মাজারে থাকতে হবে আর নিজে হাতে রান্না করে খেতে হবে । খেতে হবে পুকুরের জল । আর রাতে মাজারের পাশে মাটিতে শুতে হবে । এই একমাস গ্রামের সকলেই মাটিতে ঘুমান ।

এবার বৈশাখে গরম একটু বেশি । রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত লোকজন ছিল । তারপর ছোটো ছোটো দোকানিরা দোকান তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে গেছেন । বৃদ্ধ বোরহান উদ্দিন শা’ফকিরের এবার ঘুমাবার পালা ।

মাজারের পাশে দ্বিতীয় কোনো ঘর নেই । বোরহান উদ্দিন শা’ফকির নিজেই একটি ত্রিপল দিয়ে তাঁবু বানিয়েছেন । সেই তাঁবুর মধ্যে মাটিতে ঘুমান । ঘুম কী কোনো দিন হয় ? কিছুটা হাপানির টান । কিছুটা অদৃশ্য ঘোড়ার খুরের আওয়াজ প্রায় প্রতি রাতেই ঘুমের বিঘ্ন ঘটায় ।

অদৃশ্য ঘোড়ার খুরের আওয়াজ খাদেম হবার প্রথম দিন থেকেই শুনতে পান বোরহান উদ্দিন । বোরহান উদ্দিনের বাবা আমজাদ আলী শা’ফকির বলে গিয়েছিলেন, বোরহান, আমি না থাকলে তোকেই খাদেমগিরি করতে হবে । কখনো কখনো রাতেও থাকতে হবে । রাতে কিন্তু অদ্ভুদভাবে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনতে পাবি ! মনে হবে এক সঙ্গে অনেকগুলো ঘোড়া এসে দাঁড়ালো । তাকিয়ে দেখবি কিচ্ছু নাই । ভয় পাস না যেন বাবা ! আর এই কথা কোনোদিন কাউকে বলবি না !

বোরহান উদ্দিনের সেসব অভ্যস্ত হয়ে গেছে । কিন্তু আজকের ঘোড়ার খুরের আওয়াজটা যেন একটু অন্য রকম ! বোরহান উদ্দিন মনে মনে ভাবলেন, না , গুণে গুণে তো আঠারোটি ঘোড়াই দিয়েছি । মাজারের গায়ে তুর্কী বিজয়ের প্রতীক লম্বা বাঁশের মাথায় পতাকাও ঝুলিযেছি ! তবে ভুলটা কোথায় হলো ? নাকি , এ আমার মনের ভুল ?

চোখ বন্দ করে ঘুমাবার চেষ্টা করলেন । খক্ খক্ করে দোলা পাকিয়ে কাশি উঠে এলো । তাঁবুর মধ্যে না ফেলে কাশিটা বাইরে ফেলতে এলেন ।

কিন্তু একি ! এমন তো কোনোদিন চোখে পড়েনি ? স্বল্প পরিসর সমস্ত মেলার মাঠ জুড়ে শাদা কালো ঘোড়ায় ছেয়ে গেছে । প্রতিটি ঘোড়ার পিঠে এক একজন যোদ্ধাবেশে সৈনিক । প্রতিটি সৈনিকের মাথায় লোহার টুপি । বুকে লোহার বর্ম । কোমরে তরবারি । ঘোড়াগুলি দাঁড়িয়েছে সারিবদ্ধ । প্রথমে একটি কালো ঘোড়া । তার পিছনে অন্য ঘোড়াগুলি । কিন্তু অদ্ভুত, একটি ঘোড়াও নড়াচড়া করছে না ! একটি ঘোড়াও চি হিঁ শব্দ করছে না । সবাই যেন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে ।

সামনের কালো ঘোড়ার সৈনিকটি বেটে-খাটো । তবে বেশ হিষ্টপুষ্ট মনে হলো । হাত দুটিও বেশ লম্বা । লম্বা হাতে লাগাম ধরে আছেন, যেন ঘোড়ার কাঁধ স্পর্শ করবেন ।

কাশিটা এতক্ষণ মুখের মধ্যে ছিল । ঘাড় ঘুরিয়ে থক করে ফেলে চোখ ফিরিয়ে দেখেন কোথায় ঘোড়া ? সামনে তো কিছুই নেই ! বৃদ্ধ বোরহান উদ্দিনের মনে এতদিনের সঞ্চিত সাহস মুহূর্তে টোল খেয়ে গেল ! দ্রুত তাঁবুর মধ্যে এসে গামছায় মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লেন ! ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে আর ফজরের আজানের ধ্বনিতে !

। দুই ।
ঘুম থেকে উঠে পুকুরের জলে ওজু করে এসে নামাজ পড়লেন খাদেম বোরহান উদ্দিন । একটু আলো ফুটতেই মেলার মাঠের ধুলির মধ্যে ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখার চেষ্টা করলেন । না, এ তার মনের ভুল ! সত্যিকারের ঘোড়া এলে তো ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখা যাবে ?

বৃদ্ধ নবানু রায় ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে মাজারের মাঠে মায়ের থানের পাশে এসে অন্য একটি কালো পাথরের ওপর বসতে বসতে বললেন, ফকির ভাই , ধুলোর মধ্যে কী খোঁজো ?

— না, কিছু না নবানু দা । এমনি দেখছিলাম । বলে নবানুর পাশে গিয়ে বসলেন বোরহান উদ্দিন ।
নবানু বললেন, ফকির ভাই , মাজারের অবস্থা তো খুবই খারাপ ! উত্তর পাশের দেওয়ালটা মনে হয় এই বর্ষা পাড় করবার পারবি না । সারাই টারাই করাও !

বোরহান উদ্দিন একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, সেকি আর আমার হাতে আছে ভাই ? আমি চারশো টাকা মাইনের খাদেম । ওয়াকফ বোর্ডও দেখে না ; সরকারও দেখে না ! কত লোক আসে । মাজার দেখে । কত কিছু লেখে নিয়া যায় । কিছুই হয় না । দশ বছর ধরে এই চলছে । এ দিকে মাজারের ইট খুলে পড়তে শুরু করেছে । কী হবে আল্লাই জানে ! মাজারে চেরাগ জ্বলাবারও কেউ থাকবি না ! মোর বেটা তো কয়, চারশো টেকার খাদেম ! ওটা কোনো কাজ হলো ? তুমি করছো করো । মোক ওই কাজ করবার কন না । মুই করমু না ।

— মাজারই যদি না থাকে খাদেমগিরি কীসের করবি ? সারানোর ব্যবস্থা কিছু করো ফকির ভাই ! এই বড়ো পীর হামাগোরে হেন্দু-মুসলমান সকলের । হামরা জানি না, কে এই বড়ো পীর ? লোকে কয় বখতিয়ারের মাজার ! হামাগোরে কাছে তাই সই ! বখতিয়ার নাকি আঠারো জন সোন্য আনে এই দ্যাশ দখল কোরে নিছিলো ! বাণগড় রাজবাড়িও নাকি দখল কোরে নিছিলো ! তা রাজবাড়ি থাকতে বখতিয়ার হামাগোরে এই মাহুর কিসমত গেরামে আসছিলো ক্যা ফকির ভাই ?

— সে কি আর আমিও জানি নবানু দা ! আব্বার কাছ থেকে শুনছুনু , তিব্বত থেকে ফিরা আসে বখতিয়ার খিলজির মন খুব খারাপ হয়া গেছিলো ! তাই আর যুদ্ধ করবি না মনে কোরে বাণগড় প্রাসাদ থেকে দূরে এই এটি কুনা দুর্গ বানালো । ওই যে ঢিবি দেখছো ; পিলার ব্যার হয়া আছে , ওটা আছিলো সেই দুর্গ । সেই দুর্গত সব আছিলো । নামাজের জায়গা । থাকার জায়গা । সব । জানো তো রাজা বাদশাদের শত্রুর শ্যাষ নাই ! হায়রে মন্দ ভাগ্য ; এই দুর্গের মধ্যেই নাকি তাঁর সেনাপতি আলী মর্দান তাঁকে খুন কোরে এই এটি কুনা কবর দেয় ! লোকে নিন্দা করবি তাই কুনু মতো এই মাজারটা বানায় । দীর্ঘ একটি শোনা কাহিনি বোরহান উদ্দিন নবানুকে শুনিয়ে বললেন , জানো নবানু দা , তোমাদের এই গেরামের নাম “মাহুর কিসমত” হছে কী কোরে ?
— না, জানি না ফকির ভাই !
— ওই মন্দ ভাগ্য বখতিয়ারের নাম থেকাই মাহুর কিসমত হছে ! “মাহুর কিসমত” মানে “মন্দ ভাগ্য” !
— দারুণ তো কোল্যা ফকির ভাই ! আগে তো শোনো নাই ?
— আমিও জানতাম না নবানু দা ! এই কিছুদিন আগে বই লেখ্পি বলে আমার কাছে কিছু জানবার জন্যে একজন আচ্ছিলো । তিনি কয়া গেছিলেন ।

নবানু রায় একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সত্যিই বখতিয়ার খিলজি মাহুর কিসমত ফকির ভাই ! এত বড়ো একজন রাজা , মরলো কিনা গুপ্ত ঘাতকের হাতে ! আর কবরও হলো এমন এক জায়গায় কেউ জানে না । আমাগোরেও বোধহয় মাহুর কিসমত ! তা না হলে , মাজারটারও বা সংস্কার হবি না ক্যানে ?

— সবই আল্লাহ্’র হাতে নবানু দা ! তুমি আমি আর কয়দিন ? বখতিয়ার খিলজি অলিআল্লাহ আছিলেন । শ্যাষ জীবন এটি কুনা পীরের মতো কাটাচেন । আমরা তাঁর মাজারের সেবা করার সুযোগ পাছি এটাই মেলা । বলে বোরহান উদ্দিন উঠে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে গেলেন । নবানু রায়ও উঠে বাড়ির দিকে চলে গেলেন ।

বেলা বাড়তেই এক এক করে পসরা সাজিয়ে মুখরিত হয়ে উঠলো মাজার চত্ত্বর । বোরহান উদ্দিন স্নান-গোসল করে , খেয়ে দেয়ে অনেকটা বেলা পর্যন্ত ঘুমালেন । রাতে তো পোড়া চোখে ঘুম আসতে চায় না ।

আজ বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে । সঙ্গে কাল-বৈশাখি ঝড় ! মেলা খুব একটা জমেনি । বৃষ্টি বাতাসে বেশ একটু শীত শীত ভাব । সন্ধ্যায় মাজারটি ভালো করে ঝাড়-ঝাটা দিয়ে গুণে গুণে আঠারোটি ঘোড়া সার করে সাজালেন বোরহান উদ্দিন । গতরাতে দেখা অদৃশ্য ঘোড়াগুলির মতো একটি ঘোড়াকে সামনে রেখে বাকিগুলোকে তার পিছনে পরপর সাজালেন । পাশের বাড়ির হিন্দু বউ-ঝি’রা এসে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন । বোরহান উদ্দিন নিজেও একটি বড়ো মালসায় তেল সলতে দিয়ে বড়ো একটি চেরাগ জ্বালালেন । চেরাগটি যেন গভীর রাত পর্যন্ত জ্বলতে পারে । ভাবখানা এমন, আজ যদি অদৃশ্য ঘোড়ার পিঠে চড়ে বখতিয়ার খিলজি আসেও তাঁর মাজারে চেরাগ আর ঘোড়া দেখে খুশিই হবেন !

ঝড়-বৃষ্টিতে মেলার মাঠ আজ একটু তাড়াতাড়ি ফাঁকা হয়েছে । দুপুরে বিরানি পোলাও একটু বেশি খাওয়া হয়েছিল । তাই রাতে কিছু না খেয়েই বোরহান উদ্দিন শুয়ে পড়লেন । চোখে ঘুমও নেমে এলো । কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর হঠাৎ জেগে উঠলেন । মনে মনে ভাবলেন আজও নিশ্চয় বাইরে ঘোড়ার পিঠে বখতিয়ার আর তাঁর সৈন্যদের দেখতে পাবেন । গা থেকে চাদরটা সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন । শুক্ল পক্ষের চাঁদ দেখে মনে হলো রাত বেশি হয় নাই । পাকুর গাছের ঘন পাতার আড়াল দিয়ে যেটুকু চাঁদের আলো মাজারের মাঠে এসে পড়েছে, তাতেই মাজারের মাঠ বেশ আলোকিত । কোনো ঘোড়া বোরহান উদ্দিন শা’ফকিরের চোখে পড়লো না । আজ তাঁর মনটা মাহুর কিসমতের এক বঙ্গবিজয়ী বীরকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে ! বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কিছু দেখতে না পেয়ে তাঁবুর মধ্যে গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন ।

বিকেলের বৃষ্টিতে মাটি বেশ স্যাঁতসেঁতে এবং ঠাণ্ডা হয়েছে । সেই স্যাঁতসেঁতে ঠাণ্ডা মাটিতে শুয়ে বোরহান উদ্দিন বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করলেন । চোখে একটু ঘুমের ভাব আসতেই মনে হলো, কী যেন খুট করে উঠলো । দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলেন । না কিছু নেই । আবার মাথা নিচু করে তাঁবুর মধ্যে ঢুকলেন । তাঁবুর মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে মনে হলো, তার সঙ্গে আরেকজন কেউ যেন তাঁবুর মধ্যে ঢুকলেন । পাশে রাখা হারিকেনের চাকাটা ঘুরিয়ে আলোটা বাড়িয়ে ভালো করে দেখে নিলেন । না , তাঁবুর মধ্যে কেউ নেই । চাদর মুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন । এবার স্পষ্ট অনুভব করলেন, কার যেন ভারি নিঃশ্বাস ঘাড়ের ওপর পড়ছে ! মুখ থেকে চাদর সরিয়ে ঘাড়ের নিঃশ্বাসের দিকে ঘুরে গেলেন বোরহান উদ্দিন । কিন্তু একি ! এ যে কালকের সেই বেটে-খাটো সৈনিকটি । বোরহান উদ্দিনের বুঝতে অসুবিধা হলো না , ইনিই বঙ্গবিজয়ী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ।

বোরহান উদ্দিনকে কিছুমাত্র বিচলিত না করে সৈনিক বললেন, আমি একটু তোমার পাশে এই ঠান্ডা মাটিতে ঘুমাবো ?

বোরহান উদ্দিন দেখলেন বঙ্গবিজয়ী বীরের তরবারিতে , শিরোনাস্ত্রে রক্তের দাগ থাকলেও চোখে ক্লান্তি !
আজ বোরহান উদ্দিনের সারাদিনের ভাবনার মধ্যে ছিলেন এই বঙ্গবিজয়ী বীর । সেই বীরের ক্লান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বিমোহিত হয়ে গেলেন বোরহান উদ্দিন । বললেন , হুজুর, আমি তো আপনারই খাদেম । আপনার খেদমত করাই আমার কাজ !

বঙ্গবিজয়ী বীর বললেন, না , আজ আমি বাদশা নই ! হুজুর নই ! আজ তুমিও যা, আমিও তাই ! আজ আমি এই শীতল মাটিতে চির শান্তির নিদ্রায় নিদ্রিত হয়ে থাকতে চাই ! বলে বঙ্গবিজয়ী বীর ঘুমিয়ে পড়লেন !

বোরহান উদ্দিন নিজের গায়ের চাদরের পুরোটা দিয়ে বঙ্গবিজয়ীকে ঢেকে দিলেন । তারপর কখন নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছেন টের পাননি । ফজরের আজানে ঘুম ভাঙলে দেখেন , তাঁবুর মধ্যে নয় ; মাজারের ভিতরে উচু কবরের ওপর নিজের চাদরখান বিছিয়ে দিয়ে সেই কবর ধরে শুয়ে আছেন তিনি !