সাহিত্যের জন্য কলম ধরতে হবে জীবনের মুখোমুখি হয়ে : নিমাই ভট্টাচার্য

।।শামস ডেস্ক।।

চিরবিদায় নিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক প্রখ্যাত সাংবাদিক নিমাই ভট্টাচার্য। ২৫ জুন বৃহস্পতিবার ভারতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কোলকাতায় জন্ম হলেও তাঁদের আদি নিবাস ছিল বৃহত্তর যশোরে। খ্যাতিমান এ মানুষটির শৈশব, কৈশোরের অনেকটা বছর কেটেছে যশোরে। এ সময় লেখাপড়া করেছেন যশোরের সম্মিলনী ইন্সটিটিউশনে। আশৈশবের স্মৃতি বিজড়িত এই স্কুলের ১২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২০১৬ সালের ২০ মার্চ যশোরে এসেছিলেন নিমাই ভট্টাচার্য। পরদিন কলকাতার নিজবাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন সমাজের কথা’র বার্তা সম্পাদক, শিশুসাহিত্যিক মিলন রহমান। দীর্ঘ আলাপচারিতায় নিমাই ভট্টাচার্য তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিকতা, সংবাদপত্র, সাহিত্যাঙ্গনের নানান দিক। খ্যাতিমান কথাশিল্পী সাংবাদিক নিমাই ভট্টাচার্য’র সেই আলাপচারিতার চৌম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

‘মেমসাহেব-রিপোর্টার বাচ্চু’ দুটি চরিত্র। মেমসাহেব উপন্যাসের এই দুটি চরিত্রের অমর ¯্রষ্টা ‘রিপোর্টার’ নিমাই ভট্টাচার্য। বৈচিত্র্যময় জীবনে শূন্য থেকে শুরু করে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছেন। একাধারে প্রখ্যাত সাংবাদিক, অন্যদিকে খ্যাতিমান লেখক। সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য রচনা করেছেন অন্তত তিন ডজন বই। তাঁর লেখা বইগুলো নানাভাবে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। তবে তাঁকে মনে রাখার জন্য একটি মাত্র বই-ই যথেষ্ট। সেটি ‘মেমসাহেব’। এই ‘মেমসাহেব’র জন্যই বাংলার তরুণ সমাজের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন ‘রিপোর্টার’ নিমাই ভট্টাচার্য। শুধু চিরস্মরণীয় বললে ভুল বলা হবে; বরং মেমসাহেবে সাংবাদিকতার যে চ্যালেঞ্জিং ও বৈচিত্র্যময় জীবনকাব্য তুলে ধরা হয়েছে তাতে আকৃষ্ট হয়ে আজও তরুণ সমাজ এ পেশার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।

প্রশ্ন : আপনার সুদীর্ঘ জীবনে লেখালেখি ও সাংবাদিকতা একসাথে চলেছে। কবে থেকে যাত্রা শুরু করলেন?
নিমাই ভট্টাচার্য : ১৯৫২ সালে বিএ পাস করার পর থেকে সাংবাদিকতা শুরু করি। সাহিত্য চর্চাও শুরু করি প্রায় একই সময়েই।

প্রশ্ন: সাংবাদিকতার শুরুতেই আপনাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে, সেইদিনগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।
নিমাই ভট্টাচার্য : হ্যাঁ, সে সময় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। পুরো এক বছর বেগার খাটার পর মাসিক দশ টাকা ভাতা হয়, তাও আট আনা এক টাকার কিস্তিতে।

প্রশ্ন: সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য জগতেও আপনি সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছেন। আপনার উপন্যাস সম্পর্কে বলুন।
নিমাই ভট্টাচার্য : সাহিত্যের জন্য কলম ধরতে হবে জীবনের মুখোমুখি হয়ে। উপন্যাসে জীবন সংগ্রাম থাকবে; চোখের জল থাকবে। গাছের তলায় জড়াজড়ি, গড়াগড়ি করলে সন্তান হয়। এসব নিয়ে উপন্যাসও লেখা যায়। কিন্তু সেই উপন্যাস কালজয়ী হতে পারে না। যে উপন্যাসে মানুষের জীবন, সুখ-দুঃখ জড়িয়ে নেই, তা পাঠক প্রিয়তা পায় না। পেলেও তা স্থায়ী হয় না।

প্রশ্ন: সাহিত্যাঙ্গনে পদচারণার শুরুর কথা জানতে চাই।
নিমাই ভট্টাচার্য : আমি তখন রিপোর্টার। একদিন ‘অমৃত’ পত্রিকার সম্পাদক তুষার কান্তি ঘোষের সঙ্গে দেখা। তাঁর উৎসাহে উপন্যাস লেখা শুরু করি। আমার প্রথম উপন্যাস ‘রাজধানীর নেপথ্যে’। উপন্যাসটি ‘অমৃত’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়। বেশ পাঠকপ্রিয়তা পায়। তাঁর অনুরোধে পরে ‘রিপোর্টার’ নামে আরেকটি উপন্যাস লিখি। এটিও ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়। এরপর ‘ভিআইপি’ উপন্যাস ছাপা হয়।

প্রশ্ন: সাহিত্যে আপনার অনুপ্রেরণা ও পছন্দ সম্পর্কে কিছু বলুন।
নিমাই ভট্টাচার্য : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক। আর আমি আমেরিকার ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কাছ থেকে উপন্যাস লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। বাংলাদেশের কয়েকজন ঔপন্যাসিকের লেখা আমি পড়েছি। হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনের লেখা আমার ভাল লেগেছে।’

প্রশ্ন: আপনাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। যারা আজ সাংবাদিকতায় নবীন, তাদের সফল হওয়ার জন্য কী পরামর্শ দেবেন।
নিমাই ভট্টাচার্য : সাংবাদিক হতে গেলে দুটি জিনিস দরকার। এক হচ্ছে পড়াশোনা। পড়াশোনা না করলে ভালো সাংবাদিক হওয়া যায় না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, সূ²-প্রখর দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে, আর থাকতে হবে সততা। ‘ইউ মাস্ট বি অনেস্ট’। কেউ আমাকে বিনা পয়সায় লাঞ্চ করালো, ডিনার করালো হুইস্কি খাওয়ালো-তারপর সাংবাদিকতা হয় না। যে কোনো সাংবাদিককে এখন এক বোতল হুইস্কি দিয়ে কিনে নেয়া যায়।

প্রশ্ন : এখনকার সংবাদপত্র নিয়ে কিছু বলুন।
নিমাই ভট্টাচার্য : সাংবাদিকদের কেনা যায় বলেই এখনকার সাংবাদিকতার সেই জোর নেই। এখন এই সংবাদপত্রে তেমন কোনো খবর দেখবো না যা দেখে রাজনীতিবিদরা চমকে উঠবে। এখন কোনো রাজনীতিবিদ সংবাদপত্রকে ভয় পায় না। সব জিনিসেই কমার্শিয়ালাইজেশন হয়ে গেছে। টাকা দিয়ে কেনা হচ্ছে সবাইকে।

প্রশ্ন : কৈশোর কেটেছে যশোর সম্মিলনী স্কুলে। সে সময়ের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে কিনা?
নিমাই ভট্টাচার্য : কৈশোর কেটেছে সম্মিলনী স্কুলে। মনে হয়, ৪র্থ থেকে ক্লাস এইট, নাইন পর্যন্ত পড়েছিলাম। আমার বাবাও এই স্কুলে পড়েছেন এবং কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। তবে এই বয়সে এসে তখনকার তেমন কোনো স্মৃতি মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, তখন জ্বর হলে হেড মাস্টার বিমল কান্তির স্ত্রী আমার সেবাশুশ্রুষা করতেন, মাথায় পানি দিয়ে দিতেন। তাঁর সেই মাতৃ¯েœহের কথা মনে পড়ে। কিন্তু মা’কে মনে পড়ে না। খুব শৈশবেই তাকে হারিয়েছিলাম।

প্রশ্ন : মেমসাহেব নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই। মেমসাহেব প্রকাশের দু’বছর পর এটি নিয়ে চলচ্চিত্র হলো। সিনেমা যখন হলো- তখন আপনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রিপোর্টার বাচ্চু আপনার জীবনের ছায়া অবলম্বনে কিনা? উত্তরে আপনি বলেছিলেন, ‘আই উইল নাইদার কনফার্ম, নর ডিনাই’। ৫০ বছর পরে এসে কী বলবেন?
নিমাই ভট্টাচার্য : হ্যাঁ তখন সবাই জানতে চাইতো। মেমসাহেব আমার জীবনী কিনা। কিন্তু ৫০ বছর পর এসে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, মেমসাহেব আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। এটা সবাই জানে এবং এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

প্রশ্ন : ৫০ বছর পরও মেমসাহেব পড়ে তরুণ সমাজ সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়, কেমন লাগে?
নিমাই ভট্টাচার্য : আমার বই পড়ে যদি কেউ বা একটা প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ হয় আনন্দের কথা। বইটার গুরুত্ব বুঝতে পারে।

প্রশ্ন : পাঠকদের সম্পর্কে কিছু বলুন ?
নিমাই ভট্টাচার্য : বাংলাদেশে আমার প্রচুর পাঠক ভক্ত রয়েছে। ট্রেনে, স্টিমারে, স্টেশনে আমার বই বিক্রি হয়। ঢাকায়ও আমার অনেক বই বিক্রি হতে দেখেছি। তবে এখানে অনেক ভেজাল বইও (পাইরেটেড) বিক্রি হয়। অনেক পাঠক চিঠি লেখেন। ভাল লাগে। কারণ পাঠকরাই লেখককে বাঁচিয়ে রাখে।

নিমাই ভট্টাচার্য : ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব-অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ একসময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই.এ উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাস করেন। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। বর্তমানে তিনি কলকাতায় বসবাস করছেন।
জীবনের টানে, জীবিকার গরজে কক্ষচ্যূত উল্কার মত এশিয়া-আফ্রিকা ইউরোপ- আমেরিকা, গ্রাম-গঞ্জ, শহর-নগর ঘুরে বেড়িয়েছেন নিমাই ভট্টাচার্য। দরিদ্রতা নিমাই ভট্টাচার্যকে পরাভূত করতে পারেনি। ক্ষয় করতে পারেনি তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে। পরম উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে ভাগ্যের সঙ্গে পাঞ্জা কষেছেন তিনি। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার শিকার হন।
নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি.আই.পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারটি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন।
‘মেমসাহেব’, ‘ডিপ্লোম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনকল্যাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলো উল্লেখযোগ্য।
নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো উপন্যাসে তিনি রাজধানীর অন্দর মহলের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা অভিজাত সমাজের কুৎসিত রূপের চিত্র তুলে ধরেছেন। কোথাও নীচু তলার মানুষের সুখ-দুঃখের জীবনকাহিনী চিত্রিত করেছেন। তাঁর লেখায় কোথাও কোথাও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদও লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেক উপন্যাসে সোনালী আনন্দ দিনের বিলাপ লক্ষ্যণীয়। তাঁর লিখিত উপন্যাসগুলো সাহিত্যরস সমৃদ্ধ ও সুখপাঠ্য।