মাহমুদা রিনি

জীবনের খেরোখাতা

শুদ্ধ হও, শান্ত হও, সুন্দর হও।
সুস্থ হও, সুষম হও, সহজ হও,

নত হও, বিনয়ী হও, মার্জিত হও
উদার হও, দয়ালু হও, নির্ভার হও,

সংকল্পে অটল হও, নীতিতে অবিচল হও
মনবলে দৃঢ় হও, পদক্ষেপে সচেতন হও।

বলনে মিষ্টভাষী হও, চলনে স্বাবলম্বী হও
ভাবনায় স্থির হও, কল্পনায় বিলাসী হও।

উপরোক্ত শব্দ গুলো নিজের প্রতি নির্দেশ করা। কাওকে উপদেশ দেয়ার জন্য নয়। সেই ধৃষ্টতাও আমার নেই। শুধু উপলব্ধির বিশ্লেষণ মানুষের সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্য এগুলোই ব্যক্তি জীবনের সঠিক উপলব্ধি কিনা তা যাচাই করে দেখা। মনে হওয়া কথাগুলোর নিজস্ব কোন ব্যাখ্যা দেয়াই যায়, কিন্তু তা আদৌও সার্বিক জীবন যাপনের সাথে সামঞ্জস্য কিনা সেটা প্রশ্নের দাবি রাখে। একটা জীবনের নিজস্ব উপলব্ধির ব্যাখ্যাগুলোকে সমষ্টিগত জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা মাত্র।

শুদ্ধ হও; আমাদের জীবন যাপনের ধরণ প্রত্যেকের আলাদা। প্রতিনিয়ত আমাদেরকে ভালো-মন্দ, শুদ্ধ, অশুদ্ধ সবরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। চলার পথে পাক যেমন থাকে, পদ্মও তেমন থাকে। পাক এড়িয়ে পদ্ম আহরণ অসম্ভব প্রায়। তাই সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে নিজেকে শুদ্ধ করতে হয়। আত্মবিশ্লেষণ যার অন্যতম মাধ্যম।

শান্ত হও; আত্মবিশ্লেষণ করতে হলে আগে নিজেকে শান্ত হতে হয়। শান্ত মন ছাড়া নিজেকে বোঝা, বিশ্লেষণ বা বিচার করা সম্ভব না।

সুন্দর হও; শান্ত মন সুন্দরের পরিপূরক। সৌন্দর্যের সংজ্ঞা শুধু চেহারায় বা পোশাক -আশাকে নয়,আত্মিক শুদ্ধতায় বা ব্যক্তিত্বে সার্বজনীন সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। সুন্দরকে ধারণ করে নিজেকে সুন্দর রাখলে মন শান্ত হয়।
সুস্থ হও; সুন্দর এবং শান্ত থাকা দুটোর জন্যই দরকার সুস্থতা। শরীর সুস্থ থাকলে সেই শরীরে সুন্দর মন শান্ত হয়ে বসবাস করতে পারে। মনের সুস্থতার সাথে শরীরের সুস্থতাও নিবিড় ভাবে জড়িত।

সুষম হও; আমরা জানি শরীর ও মনের নিত্য নতুন চাহিদা তৈরি হয়। চাহিদার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শরীরের চাহিদা, মনের চাহিদার সুষম বণ্টনের জন্যই আমাদের সুষম হতে হয়।

সহজ হও; জীবনকে জটিল পথ ধরে চলতে হয়। নানান ধরনের জটিলতা আমাদের অস্থির বা উদগ্রীব করে তোলে। শান্ত, সুস্থ মন সবধরনের জটিলতাকে পাশকাটিয়ে সহজ পথে চলতে পারে। আমাদের ভাবনার জায়গা গুলো স্বার্থ, পরশ্রীকাতরতা, লোভ,মোহ, হিংসা নানাবিধ জাগতিক অনুভূতি জড়িয়ে পেঁচিয়ে জটিল করে তোলে। আমরা যদি চেষ্টা করি ভাবনার জায়গা গুলোর জট ছাড়াতে, নির্মোহ দৃষ্টিতে সহজ করে ভাবতে, তাহলে অনেক জটিল বিষয়ও সহজ হয়ে আসে।

নত হও; ফলভারে বৃক্ষ নত হয়। আমরা যদি জ্ঞান আহরণ করার চেষ্টা করি তাহলে আমাদেরও নতই হতে হবে। এই নত হওয়া মানে নিজেকে ছোট করা নয়। জ্ঞানের সামনে, বিশালতার সামনে নিজের ক্ষুদ্রত্বকে স্বীকার করা।

বিনয়ী হও; একই সাথে বিনয়ও এমন একটা গুণ যা শুধু আমাদের সবসময় মহৎ করে। বিনয় মানে তুমি যা, যেটুকু সেই ক্ষুদ্রতাকে মনে রাখা। নিজের অক্ষমতাকে সরল ভাবে স্বীকার করা এবং তাকে অতিক্রম করতে না চাওয়া।  বিনয়কে আয়ত্ত করতে পারলে চলার পথ সহজ ও সম্মানজনক হওয়া সম্ভব।

মার্জিত হও; আত্মশুদ্ধি, আত্মসমালোচনার পরিমার্জিত রূপই তেমন মার্জিত হওয়া।
উদার হও; মনের আগল খুলে দূষিত বিষয় বের করে দিতে পারলে নিজেকে উদার মনে হবে। যা আত্মতৃপ্তিতে সহায়ক।  দয়ালু হও; সকল সৃষ্টির প্রতি দয়ালু হওয়াও জীব ও প্রকৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নির্ভার হও; নেতিবাচক ভাবনা বা মনোভাব বাদ দিয়ে আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে তাকে সহজ ভাবে মেনে নেয়া এবং পরিবেশ ও প্রকৃতিকে সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারলে  নিজেকে নির্ভার মনে হয়।

সংকল্প অটল; আমরা অনেক সময় কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে আগুপিছু চিন্তা করে বার বার ইতস্তত হই। লক্ষ্য যদি সঠিক হয়, নিজের মন যদি সঠিক বলে আর তা যদি নিজের বা সমাজের কোন ক্ষতি সাধন না করে তো যে যাই বলুক সেই সংকল্পে অটল থাকা উচিৎ বলে মনে করি।

নীতিতে অবিচল; নীতির সাথে আপোষ হয় না এটাকে বিশ্বাস করে মেনে চলা এবং নিজের বিশ্বাসের প্রতি মনোবল দৃঢ় রাখা। লাভ-ক্ষতি, স্বার্থ, লোভ যে কোন কারণেই নীতিতে অবিচল থাকা।

পদক্ষেপে সচেতন হও; জীবন চলমান। সেই চলা মননে হোক, চেতনায় হোক বা পদক্ষেপে! সবক্ষেত্রেই নিজেকে সচেতন রাখলে ভুল ভ্রান্তি কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গন্তব্যে পৌঁছাতে পথ নিষ্কণ্টক হতে পারে।

মিষ্টভাষী হও;  জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম মনে হয় ভাব প্রকাশ এবং ভাবের আদান-প্রদান যা আমরা কথা বলার মাধ্যমেই প্রধানত করে থাকি। আপন-পর, শত্রু- মিত্র, বন্ধু-স্বজন সব সম্পর্কই নির্ভর করে ভাব প্রকাশ বা কথা বলার মধ্য দিয়ে। কথার কারণেই বন্ধুত্ব হয় আবার এই কথার কারণেই শত্রুতার সূত্রপাত হয়। মিষ্টভাষী মানুষের শত্রু কম হয় বলেই আমার ধারণা। নিজের মনেও শান্তি পাওয়া যায়।

চলনে স্বাবলম্বী হও ; প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব কর্মপরিধি আছে। নিজের দায়িত্বে, কর্তব্যে ও কর্মে অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে আত্মনির্ভরশীল হলে সম্মান, সমৃদ্ধি ও আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়।

পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থায় সুষ্ঠু সুশৃঙ্খল, সুন্দর জীবন যাপনের জন্য প্রত্যেকটি বিষয় চেইন অব সিস্টেমের মত একটার সাথে আরেকটা জড়িত।

ভাবনায় স্থির, কর্মে পূর্ণ মনোনিবেশ, চলনে স্বাবলম্বী, সিদ্ধান্তে ধীর ইত্যাদি আমাদের জীবনকে সহজ, সুন্দর করে দিতে পারে। শুধু কল্পনায় আমরা ইচ্ছা মত বিলাসী হতে পারি। কল্পনায় আমরা আকাশ ছুঁতে পারি। হিমালয় জয় করতে পারি, চাঁদকে হাতের মুঠোয় আনতে পারি, করে ফেলতে পারি আরও অনেক কিছু। কল্পনা বিলাসী মনের সুন্দর কল্পনায় আমাদের একদিন সেই কল্পনার লক্ষ্যেও পৌঁছে দিতে পারে নিশ্চয়ই।