মাহবুব সিদ্দিকী

আমের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার

আম নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। উৎকৃষ্টতার বিচারে কোন জাতের আম শ্রেষ্ঠ, এ প্রশ্নের কোন মীমাংসা আজ অবধি হয়নি। সম্ভবত: কোন দিনই হবেনা। এর কারণ রয়েছে। আমকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পৃথিবীতে এতোকাল হয়ে এসেছে এবং হয়ে চলেছে। আসলে আম্র সংস্কৃতির প্রভাব জনজীবনের নানা কর্মপরিসরের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন আম উৎপাদনকারী দেশ বা অঞ্চলের মানুষদের নিজ নিজ এলাকায় উৎপাদিত জাতকে নিয়ে গর্ব এবং অহংকারের শেষ নেই। এরূপ ভাবনা এসেছে আঞ্চলিকতা, জাতীয়তাবোধ কিংবা দেশাত্ববোধ থেকে। কোন অঞ্চলের কয়েকটি উৎকৃষ্ট জাতের আমের আস্বাদে অভ্যস্থ, সেখানকার জনসাধারণ দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন যে, তাদের এলাকায় উৎপাদিত তৃপ্তিদায়ক আমগুলোই পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। আবার এমনও দেখা যাবে একটি দেশের মধ্যেই কয়েকটি অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ এবং সুগন্ধযুক্ত অতি উৎকৃষ্ট মানের আম উৎপন্ন হচ্ছে। সেই অঞ্চলগুলোর জনসাধারণ তাদের নির্বাচিত স্ব স্ব এলাকার আমগুলোকেই শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করেন। অন্য অঞ্চলের আম তাদের কাছে ততোটা গুরুত্ব পায় না।

বাংলাদেশকে দিয়েই উদাহরণ শুরু করা যেতে পারে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার জনসাধারণের মধ্যে একটি বিশ্বাস এবং অহংকার কাজ করে যে, তাদের এলাকায় উৎপাদিত আম বিশেষ করে ফজলী, ল্যাংড়া, ক্ষীরসাপাত রাণী পছন্দ, গৌরমতি দেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমের আভিজাত্যের মাপকাঠিতে নবাবগঞ্জের অবস্থান শীর্ষে। রাজশাহী মহানগরীর অভিজাত আম ভোক্তাগণ রায়পাড়া বাগানের নির্দিষ্ট কিছু আমকে শ্রেষ্ঠ বলে থাকেন। এই বাগানের আম এরা নাগালের মধ্যে পেলে, আশে পাশে আর তাকানোর কোন প্রয়োজনই মনে করেন না।

রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট অঞ্চলের লোকজন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তাদের উৎপাদিত ফজলী এবং লক্ষণভোগ দেশের মধ্যে সেরা। অপরদিকে নাটোর অঞ্চলের মানুষ গোপালভোগ বা কালুয়া নামক আমকে সর্বশ্রেষ্ঠ আম বলে দাবী করেন। নওগাঁ অঞ্চলে উৎপাদিত নাক ফজলী, আমের মধ্যে গুণেমানে সর্বশ্রেষ্ঠ, এই বিশ্বাসে তারা বিশ্বাসী। এদিকে মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গার মানুষ তাদের অঞ্চলের বোম্বাই আমের সাথে অন্য কোন আমের তুলনা করতে নারাজ। একইভাবে সাতক্ষীরার মানুষরা তাদের ল্যাংড়া ও গোবিন্দভোগ আমের প্রশংসায় পঞ্চমূখ।

রংপুরের মানুষদের একথা বুঝানো খুব মুশকিল হবে যে, হাঁড়িভাঙ্গা আমের চেয়েও ভাল ভাল আম বাংলাদেশে রয়েছে। একইভাবে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের মানুষ বুঝতেই চাইবেন না, সূর্যপুরী আমের চেয়েও ভালজাতের আম দেশে থাকতে পারে। দিনাজপুর জেলায় একটি প্রবাদ বা লোক বিশ্বাস এখনও মানুষের অন্তরে দৃঢ়ভাবে গেঁথে রয়েছে আর সেটি হচ্ছে- কাটারিভোগ চালের ভাতের সঙ্গে দুই জালের খাঁটি গোদুগ্ধ আর তার সঙ্গে সুপক্ক একটি মিশ্রীভোগ আমের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে যে খাদ্য বস্তু প্রস্তুত হবে নি:সন্দেহে তা তুলানরহিত।

ভারতের অবস্থা আমাদের দেশের মতোই। দক্ষিণ ভারতীয় বিশেষ করে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও কর্নাটকের লোকেরা সহজভাবে স্বীকার করতে কখনই চাইবেন না যে, গোটা ভারতে ‘আল্লামপুরবেনীশান’ এই আমটির চেয়ে উৎকৃষ্ট কোন আম রয়েছে। তদ্রুপভাবে একজন বোম্বেওয়ালা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, তাদের আলফনসো আমকে পেছনে ফেলার মতো আমের অস্তিত্ব ভারতে নেই। অপর পক্ষে উত্তর ভারতের লোকজন তাদের ‘দুসেহরী’ বা দসেরী এবং চৌষা আমকে পৃথিবীর যে কোন উন্নতজাতের আমের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করেন। বিহার রাজ্যের মানুষ কখনই বুঝতে চাইবেননা যে, বেনারশের ল্যাংড়া আমের চেয়ে উন্নত আম পৃথিবীতে থাকতে পারে।

একইভাবে একজন থাইল্যান্ডবাসী বিশ্বাস করেন, তাদের দেশে উৎপাদিত নাম ডক মাই নামের আমটি পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ, এমনিভাবে একজন ফিলিপিনো মনে করেন তাদের দেশের শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত ক্যারাবাউ এবং পিকো এই দুটি আমের ধারে কাছে পৃথিবীর কোন আম নেই। একজন পাকিস্তানির ধারণা, তাদের দেশের আনোয়ার রাতাউল, মোহাম্মদওয়ালা এবং সিন্ধরী এগুলোর স্বাদ এবং গন্ধ তুলনাহীন। সাধারণভাবে বাংলাদেশীদের ধারণা- ল্যাংড়া, ক্ষীরসাপাত গোপালভোগ, এবং হিমসাগর এগুলোই হচ্ছে পৃথিবীর সেরা আম।

এসব কিছুই আমের প্রতি মানুষের ভালবাসা, নিজেদের এলাকা তথা দেশের প্রতি গভীর ভালবাসার দৃষ্টি ভঙ্গীঁ থেকে উৎসারিত। আম সংক্রান্ত বিষয়গুলো পর্যাবেক্ষণ ও নিরীক্ষার পর আম বিশারদ ও আমভক্ত মানুষদের মতামত হলো- বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে উৎপাদিত আমের ভাল ভাল জাতগুলোই পৃথিবীর মানুষকে আকৃষ্ট করেছে সবচেয়ে বেশী।

দক্ষিণ এশিয়ার এই তিনটি দেশ ব্যতীত পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলিতে যে যে জাতের আম উৎপন্ন হচ্ছে, সন্দেহ নেই সেগুলি আকারে বেশ বড়, কোন কোনটির রং আকর্ষণীয় কিন্তু অধিকাংশই আঁশে ভরা। স্বাদ এবং সুগন্ধের মধ্যেও অনেক ফারাক। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বেশিরভাগ উন্নত বাণিজ্যিক জাতগুলো স্বাদে অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক। অধিকাংশ আমের রং আকর্ষণীয়, আর পাগল করা সুগন্ধ। এই দেশগুলোর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতের আম বাছাই এবং সেগুলোর গুণাগুণ বিচার করে, ক্রমানুসারে সাজানোর কাজটি কখনই সঠিক হবে না। সেটি সম্ভবও নয়। আম সব সময়ই ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভরশীল। কারোর কাছে মিষ্টতার পরিমাণ হচ্ছে উৎকৃষ্টতার মাপকাঠি, আবার কারোর কাছে মধুমাখা গন্ধ, আকর্ষণীয় রং এবং রসের পরিমাণ ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। আমের সুরভী, স্বাদ, মিষ্টতা, রং, আঁশের পরিমাণ ইত্যাদি বিচার করে এই তিনটি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ আমের জাতগুলোর নাম নিচে দেওয়া গেল।

ল্যাংড়া, আলফনসো, চৌষা, গৌরমতি, দসেরী, আল্লামপুর বানেশান, সামার বাহিশ্, ক্ষীরসাপাত, হিমসাগর, আম্রপালি, শাদওয়ালা, গোপালভোগ, সিন্ধরী, আনোয়ার রাতাউল, হিমাউদ্দীন, বাংগানপাল্লি, জর্দালু, আজিজপছন্দ, আলফান, রাণীপছন্দ, জাহাঙ্গীর, খাসুলখাস, সফদারপছন্দ (বিড়া), মালগোভা, মোহাম্মদওয়ালা, বারি আম-৪, বোম্বে গ্রীণ, হাড়িভাঙা, সূর্যপুরী, সুরমা ফজলী, মল্লিকা, তোতাপুরী, মিশ্রীভোগ।