পরাগ রশিদ

ধূলিঝড়

আর কতোক্ষণ এই বাসের লাইনে দাড়িয়ে থাকবো? সন্ধ্যা নেমে আসছে। ঝড় নামবে বোধহয়। ধূলিঝড় হচ্ছে। বাতাসের সাথে ধূলা উড়ে এসে চোখে ঠোটে লেগে যাচ্ছে। লিপস্টিকের উপর বালিগুলো আটকে যাচ্ছে। কি বিশ্রী একটা অনুভূতি। কোথাও বোধহয় নিম্নচাপ হচ্ছে, না হলে তো এই ডিসেম্বরে বৃষ্টি হবার কথা না। বাসও আসছে না। এতো দূরের পথ বেবিটেক্সিতে অনেক ভাড়া নেবে। এ মুহূর্তে এতো টাকা দিয়ে টেক্সি ভাড়া করা আমার পক্ষে সম্ভব না। এই নয় নম্বর বাসে বাদুর ঝোলা হয়ে অফিস করতে আর ভালো লাগেনা।

এই দিনগুলোর তো শেষ নেই। প্রতিদিন একই রকমের দিন। আল্লাহ্ যে কবে এই একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিবে! ঐ যে একটা বাস আসছে। এখন মনে হয় শ খানেক লোকের সাথে যুদ্ধ করে বাসে উঠতে হবে।

এসব ভাবতে ভাবতে রওশনআরা লাফ দিয়ে বাসে উঠে ।এই বাসে ওঠার জন্য যে সে কতোদিন জুতো জোড়া খুলে ব্যাগে ভরে নিয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই। ঠেলে ঠুলে বাসে ওঠার পর একটা সিটও সে পেয়েছে। এই সিটটাতে কেউ বসে নাই কারন এর জানালার কাচ ভাঙা। রওশনআরা তাও বসলো। এতোক্ষন রাস্তায় দাড়িয়ে থেকে ওর পা দুটো ভেঙ্গে আসছিল। তার মধ্যে হয়েছে শরীর খারাপ। খুব অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি। যদিও ভাঙ্গা জানালার ফাক গলিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা গায়ে মুখে এসে পরছে। ভিজে গেলেও একটা শীতল অনুভূতি ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

মাঝে মাঝে নিজের জন্য বড় করুনা হয় ওর। বিশেষ করে এই ডিসেম্বর মাসে বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। এতো বৃষ্টি একঝটকায় নিয়ে যায় ওকে একাত্তরের সেই দিনগুলোতে। স্মৃতি গুলো ওর কাছে মাসিকের রক্তের মতোই নোংরা দূর্গন্ধময় মনে হয়। মন থেকে যতো চায় মুছে ফেলতে ততোই স্পষ্ট হয়ে চোখে ভাসে।

রওশনআরা বানু সিরাজগঞ্জের এক বনেদি পরিবারের অতি আদরের কনিষ্ঠ মেয়ে। তখন সে সবে ক্লাস টেনে পড়ে। সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে পড়ার খুব শখ ছিল ওর । দুচোখে ভরা স্বপ্ন! কিন্তু ওর বাবা আর বড় ভাই মিলে নওগাঁর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলের সাথে রওশনআরার বিয়ে ঠিক করে। নওগাঁতে এই পরিবারের যথেষ্ট নামডাক ছিল। এরা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতো আরকি । রওশনআরার স্বামী মাস্টারির পাশাপাশি সমাজ সেবা করতো। ওদের বিয়ে হয় উনিশ শ’ পয়ষট্টি সালে। স্বামী হিসেবে জাকির খারাপ ছিল না। রাজনীতি করলেও সংসারী মানুষ ছিল সে। বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতো। বছরের এ মাথায় ও মাথায় রওশনের বাচ্চা হয়েছে।

একাত্তরের অগাস্টে তুমুল গন্ডোগোলের সময় রওশন আরার স্বামী চার বাচ্চা সহ রওশনের ভাইয়ের বাসায় রেখে যুদ্ধে চলে গেল । যাবার সময় শুধু বলে গেল, তাঁর ডাক উপেক্ষা করি কিভাবে ! তিনি অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। তিনি আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক । তাঁর আদর্শে, তাঁর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এসময় আমি ঘরে থাকি কি করে রওশন?

রওশন তখন পঞ্চম বারের মতো গর্ভবতী। ভাইদের ঘরেই গন্ডা খানেক বাচ্চা কাচ্চা তার মধ্যে রওশনের চারটা। কি একটা ভয়ংকর অভাবের সময়। বাচ্চাগুলো সারাদিন শুধু খাই খাই করে। শরমও লাগে। একটা টাকা কড়িও হাতে দিয়ে যায় নাই বাদলের আব্বা যে তা দিয়ে একবেলা অন্তত বাজার করবে ভাইদের সংসারে। যুদ্ধের দিনগুলোতো রওশনআরা সারাক্ষণ মনে মনে বলতো,’ আল্লাহ আমি স্বাধীনতাটতা বুঝিনা। আমি শুধু শান্তি চাই। পেট ভরে ভাত খেয়ে বাসনা তেল মাথায় দিয়ে ঘুমাতে চাই। আমি ভয় শঙ্কা ছাড়া ঘুমাতে চাই। আমি বাদলের আব্বার সাথে অন্ধকার রাতে জোনাকি পোকার মিটমিট আলোতে ফিসফিস করে কথা বলতে চাই। আমি আমার নিজের ঘরের উঠান ঝাড় দিয়ে কবুতর গুলোকে আদার দিতে চাই। আমি আমাদের পাগাড়ে ডুব সাতার দিতে চাই। আমি আবার আমার ঘরে ফিরে যেতে চাই আল্লাহ। আপনি আমাদের এই বিপদ থেকে মুক্ত করেন।’

রওশনআরার পেটে তখন চার মাসের বাচ্চা। একদিন ভর দুপুরে ওদের বাড়ি পাক বাহিনীর জোআনরা এ্যাটাক করলো। যে যেখানে পারে সবাই লুকিয়েছিলো কিন্তু হঠাৎই ছোট মেয়েটা কান্না করে দেওয়ায় ওরা গোয়াল ঘরের ভেতরে ধরা পরে গেল।

রওশনআরাকে সাত আটজন জওয়ান টেনে হেচড়ে উঠোনে নিয়ে এসে উলঙ্গ করে ফেলে ওর সন্তানদের সামনে। অট্টহাসিতে ওরা ফেটে পরছিল। ওর অনুনয় ওদের কানে পৌঁছালো না। ওরা রওশনের সারা শরীরের সব স্থানে ওদের নোংরা স্পর্শে ক্ষতবীক্ষত করে ফেলেছিল।

রওশনআরার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে রক্তে ছয়লাব হয়ে যাচ্ছিলো। বৃষ্টির পানির সাথে রক্ত মিশে সারা উঠোনে লাল রক্তের বন্যা বইছিল তখন । রওশনের গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। কি জঘন্য নোংরা লাগছিল ওর নিজেকে। চারপাশে শুধু মাশিকের রক্তের গন্ধ। ওর শুধু মনে হচ্ছিলো ওরা ক্রমাগত ওকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। গা ঘৃণায় গুলিয়ে আসছিল । রওশন ওর ভাবীকে বললো,’ আমাকে একটা আতর দিবা। আমি নাকের কাছে ধরে রাখবো।’ ভাবী অবাক হয়ে বলে কোনো গন্ধ তো আমরা পাচ্ছি না।তোমার এমন হচ্ছে কেন। এরপর বহুদিন রওশন দিনে রাতে অসংখ্যবার গোসল করতো, সারা গায়ে আতোর মেখে, বিছানায় আতোর ছিটিয়ে রাখতো। তাও সে সেই বিভিষিকাময় সময়ের গন্ধকে ভুলতে পারেনি।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। বাদলের আব্বা যুদ্ধ শেষে আর ফিরে আসে নাই।

বাদলের আব্বার লাশটা হয়তো শেয়াল কুকুরে খাওয়ার পর পচে গলে কোথাও মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। রওশন চোখ বন্ধ করে শুধু বাদলের আব্বার কন্ঠ মনে করার চেষ্টা করে।

কি ভয়ংকর অভাব ভাইদের সংসারে। রাজাকাররা ওদের সব লুট করে নিয়ে গেছে। একবেলাও ঠিক মতো খাবার জোটে না। এভাবে কেটে গেল আরও একটা বছর। উপায়ন্তর না দেখে দুই ভাই মিলে বৈঠক বসালো। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো চারটা বাচ্চার মধ্যে ছেলে দুটাকে রওশনের ভাসুর নিবে আর মেয়ে দুটাকে ওর ভাবীরা রাখবে। ঘরের কাজের জন্যও তো লোক লাগে তাদের। সেই হিসেবেই রাখলো ওরা মেয়ে দুটোকে।

বড় ভাই রওশনকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে বললেন। রওশন ভয় পেয়ে বলল,’ আমি কিচ্ছু পারিনা, কতো দিন পড়ালেখার সাথে কোনো যোগাযোগ নাই। সব ভুলে গিয়েছি বলতে গেলে। আমার পক্ষে আর সম্ভব হবেনা দাদাভাই।’

দাদাভাই আশ্বাস দিয়ে বললেন যে শুধু পরীক্ষার হলে বসলেই হবে। আর কিচ্ছু করতে হবেনা। পাশ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্ । এবার অতো কড়াকড়ি হবে না পরীক্ষার হলে’। সাহস করে রওশন পরীক্ষা দিল। সে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছিল উনশ শ’ চুয়াওর সালে।ভাই সব জায়গায় চাকরির দরখাস্ত করে একটা আধা সরকারী অফিসে স্টোনোগ্রাফার হিসেবে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন রওশনকে।

ঢাকা শহরে ফুপাতো বোনের বাসায় থেকে রওশন অফিস করে। মনে মনে একটা দৃশ্যই ভাবে সে, চারটা বাচ্চাকে আবার নিজের কাছে এনে রাখবে। লালমাটিয়া বয়েজ এ্যন্ড গার্লস স্কুলে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করবে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে চার বাচ্চার সাথে একসাথে বসে ভাত খাবে ।

সারাদিন অফিসে টাইপরাইটার মেশিনের শব্দে মাথা ধরে থাকে রওশনের। যখন ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরে আসে তখন ভীষণ ফাপোর লাগে ওর। আপা যখন ভাতের থালাটা রওশনের হাতে দেয় তখন আর ভাত গলা দিয়ে নামাতে পারেনা রওশন। বাচ্চা গুলোর চেহারা চোখে ভাসে। মাসিকের রক্তের গন্ধ নাকে এসে লাগে। থালা ভিজে যায় চোখের পানিতে। গলা ধরে আসে ওর। ঢোক গিলতে পারেনা। চিৎকার দিয়ে কাদতে চায় রওশন কিন্তু কাদতে পারেনা। চোখ বন্ধ করে সে শুধু বাদলের আব্বার কন্ঠ মনে করার চেষ্টা করে। ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে বসে থাকে রওশন, ভাত আর খেতে পারেনা ।

আজকে যখন ডিডি স্যার ডেকে বললেন রওশনআরা বানু আপনার শরীর দেখে মনেই হয় না আপনি চার বাচ্চার মা। শরীর প্রসঙ্গে আরও অনেক কথা বললেন উনি। কথা গুলো আর কানে যাচ্ছিলো না রওশনের, তার চোখে শুধু সেই পোশাক পড়া পাক হানাদারদের অবয়বের সাথে এই ডিডি স্যারের অবয়বের, অঙ্গভঙ্গির, চোয়াল প্রশস্ত করে হাসির হুবহু মিল ধরা পরছিলো। পার্থক্য ছিল শুধু পোশাকে আর ভাষায় ।

মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘূরপাক খায় রওশনের। সে হিসেব মিলাতে পারে না। পাক হানাদারদের থেকে মুক্তি পেলেও দেশি হায়েনাদের লোভ আর বিকৃত লালসা থেকে দেশ তো মুক্ত হয়নি। নাহলে কি এটা সম্ভব হতো, যার জন্য দেশ স্বাধীনতার আলো দেখতে পেল সেই জাতির জনককে সপরিবারে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী লোভী বিশ্বাসঘাতক অফিসার হত্যা করে! হায়নারা তাতেও ক্ষান্ত হয় নি জেলখানায় চার নেতাকেও হত্যা করেছে তারা।

রওশন গভীর ভাবনায় ডুবে যায়,’এতো বড় বলিদানের পর দেশের স্বাধীনতা কি রক্ষা পেয়েছে ! অপরাধ না করেও কেন অপরাধের গ্লানি মাথায় নিতে হচ্ছে আমাকে! কেন দাদাভাই অনুনয় করে মানা করেছিল বীরাঙ্গনা খেতাব না নিতে! তাহলে কি ধর্ষিত হবার জন্য আমিই দায়ী! আচ্ছা মৃত্যুর সময় কি বাদলের আব্বার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো! সে কি বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলো?

এটাই কি স্বাধীন দেশের নমুনা! যেখানে একজন মায়ের চারটা বাচ্চা মানুষের বাড়িতে ঝি চাকরের মতো থাকে! যার শরীরটা লোলুপের ঘৃন্য স্পর্শের বাইরে না! যার নাকে এখনও পচা রক্তের গন্ধ লেগে আছে! যাকে একটা বাসের সিটের জন্য তুমুল লড়াই করতে হয়। বাসের ভাঙ্গা জানালায় বসে যে এখনও বৃষ্টির পানিতে চোখের পানি লুকায় সেই রওশনআরা বানুর স্বাধীনতা কোথায় এই স্বাধীন বাংলায়?