জহিরুল জিতু

শ্রীলংকার বিশ্ব ঐতিহ্য সিগিরিয়া ভ্রমণ

শ্রীলংকার বিশ্ব ঐতিহ্য সিগিরিয়া ভ্রমণ

সম্প্রতি খবর মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রায়শূন্য হয়ে শ্রীলংকা দেউলিয়া হওয়ার পথে। আর্থিক সংকটের মধ্য শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে সরকার দিশেহারা। সরকার বলছে, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রধানত দায়ী করোনা পরিস্থিতি। এছাড়া পর্যটন খাতের বিপর্যয়ও এ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে মারাত্মক ভূমিকা রেখেছে। হ্যা, দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার আয়ের একটি বড় উৎস হলো পর্যটন খাত। ২০১৫ সালে আমিও গিয়েছিলাম শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে। তখন কিন্তু মারাত্মক আর্থিক সংকটে ছিল না শ্রীলঙ্কা। সাত দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কার সাময়িকভাবে ঋণ খেলাপি হওয়া এবং বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার এর কথা আপনারা সবাই জানেন। আজ আমি এখানে আমার দেখা শ্রীলংকার বিশ্ব ঐতিহ্য সিগিরিয়া সহ কলম্বো ও ক্যান্ডি ভ্রমণের কথা বলবো।

কলম্বো শ্রীলঙ্কার পশ্চিম উপকূলের একটি শহর। এটি কালানী নদীর মোহনায় অবস্থিত শ্রীলংকার একটি প্রধান সমুদ্রবন্দর। কলম্বো শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যিক রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হিসেবে পরিচিত। শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ বৈদেশিক বাণিজ্য কলম্বো সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বন্দরটি জাহাজে পুনরায় জ্বালানি ভরার জন্য ব্যবহৃত হয়। অনেক আগের কালে কলম্বো শহরটির নাম ছিল কালান-তোত্তা। কালান-তোত্তার অর্থ কেলানি নদীর ফেরিঘাট। আরব নাবিকেরা যখন এদেশে আসেন তখন তারা এর নাম দেয় কালাম্বু। তারও অনেক পরে ১৫১৭ সালে পর্তুগিজেরা এই বন্দরে পা রাখলে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সম্মানে শহরের নাম বদলে কলম্বো রাখে। তারপর থেকে আজও এটি কলম্বো নামে সুপরিচিত। ছিমছাম শহর। রাস্তাঘাট অনেক ফাঁকা ফাঁকা। পাহাড়ি ঢাল চোখে পড়ার মতো। রাস্তাঘাটও সেভাবে অসমতল। প্রথমেই বিমানবন্দর থেকে আমাদেরকে কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসর রিসিভ করলেন এবং তার দামী প্রাইভেট কারে করে কলম্বো বন্দরের পাশ দিয়ে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে একটু ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা খাওয়ার পর আমাদের কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডরমিটরিতে পৌঁছে দিলেন। অমায়িক ব্যবহার। নিরহংকার মানুষ। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক তাই ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে অনেক কিছু জানালেন। রাত নেমে আসলে তিনি চলে গেলেন। বারান্দায় বের হয়ে রাতের আলো আধাঁরির দিকে তাকিয়ে শ্রীলঙ্কাকে দেখার প্রচেষ্টা চালালাম কিছুক্ষণ। রাতের নিরবতা নেমে আসলো। ঘুমাতে চলে গেলাম। আগামীকাল সকালে আবার কনফারেন্স রয়েছে। সকালের নাস্তা সেখানে করতে হবে। পরের দুইদিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে চলে গেল। শুধু কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখা হলো। অনেক সুন্দর করে সাজানো ক্যাম্পাস।

এরপর গল্ ফোর্ট ঘুরে অসলাম। সেখানে মেরিন জাদুঘর, গল্ ফোর্ট জাদুঘর রয়েছে। ভারত মহাসাগরের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো গল ফোর্ট। সোয়া চারশো বছরের বেশি সময় আগে ১৫৮৮ সালে পর্তুগিজদের গড়া এই দুর্গ স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন। ৫০ বছর পর্তুগিজদের শাসনে ছিল এ দুর্গ। এরপর ওলান্দাজরা এসে এটি দখল করে। তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ১৫৬ বছর। ১৭৯৬ সালে গল দুর্গ দখল করে ব্রিটিশরা। পাহাড় সমান এই ফোর্টের প্রাচীর যেমন উঁচু তেমনি এর বিস্তৃতি। প্রাচীরগুলো এত চওড়া ও মজবুত যে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে তার উপর দিয়ে দলেবলে হাঁটা যায়, বসা যায়। দেয়ালের উপর থেকে শহরের দিকে তাকালে সহজেই চোখে পড়ে শ্রীলংকার বিখ্যাত গল ক্রিকেট স্টেডিয়াম।

যাইহোক তারপরের দিন আমরা গেলাম রাজধানী কলম্বো থেকে প্রায় ৫ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে শ্রীলঙ্কার নান্দনিক শহর কেন্ডিতে। তারপরের দিন পৌঁছে গেলাম আমাদের অতি আকাংক্ষিত সেই শ্রীলংকার সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান সিগিরিয়া প্রাসাদ স্থাপত্য। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক এক পুরনো নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দর্শনীয় স্থান উপভোগ করছে।

সিগিরিয়ার মূল আকর্ষণ ছয়শ ফুট উঁচু পাথরের পাহাড়, যেখানে রয়েছে রাজাদের প্রাসাদ, পুকুর, বৈঠকখানা ইত্যাদি। অনেক দূর থেকে দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন পাহাড়টি একটি অখন্ড বড় পাথর। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার আগেই চারদিকের মনোরম দৃশ্য দেখে একবারে মুগ্ধ। এই পাহাড়ের পাদদেশে এক সময় একটি সভ্যতা ছিল। তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই সিগিরিয়া প্রত্নস্থলটি।

আর্কিওলজির শিক্ষক আমাদেরকে পৃথিবীখ্যাত ‘সিগিরিয়া রক’ বা ‘লায়ন রক’ সম্পর্কে জানালেন। সবকিছুই ছিল ইংরেজিতে। আমি এখানে কিছুটা সংক্ষেপে তার বিবরণী তুলে ধরার চেষ্টা করছি। রাজা কাশ্যপ নামে খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে শ্রীলঙ্কার এক নৃপতি ছিলেন। ভারতীয় জলদস্যু এবং সৎভাই ম্যাগনোলার ভয়ে তিনি এই পাথরের প্রাসাদ নির্মাণ করেন। জানা যায়, প্রাসাদে একটি সুইমিংপুল, পাঁচশ রক্ষিতা ছিল। এখনও পাহাড়ের গায়ে এদের অর্ধ-নগ্ন ও নগ্ন চিত্র আঁকা আছে। এটাকে রক আর্ট বা পেইন্টিং বলে। অনেকটা আমাদের বাংলার পালপুথিঁ চিত্রকলার মতো । ভীতু রাজা সব সময় দূর্গের ভিতর অবস্থান করতেন। একদিন ম্যাগনোলা বিশাল হাতির বহর নিয়ে আক্রমণ করে সেই দূর্গ। সুসজ্জিত সেনাবাহিনীসহ রাজা কাশ্যপ পরাজিত হয়ে আত্মহত্যা করেন। দর্শনীয় এই রকটি দখলে আসে বীর ম্যাগনোলার। তারপর এতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাস করতে শুরু করে।

লেখক

সিগিরিয়া হচ্ছে শ্রীলংকার একটি অপূর্ব সুন্দর গুহামন্দির। ছয়শত ফুট উঁচু এক পাথর কেটে দুর্ভেদ্য প্রাসাদ বানিয়েছেন ঐ রাজা। প্রাসাদ অনেকটা মৌচাকের চাকের মতো। এই পাথর ‘সিগিরিয়া রক’ নামে ভুবন বিখ্যাত। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে পরিচিত এই সাইটটি বৌদ্ধমন্দির হিসেবে চৌদ্দ শতক পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো।

সিগিরিয়া দুর্গের পাথরের প্রবেশপথটি একটি বিশাল সিংহমূর্তির মতো। সিংহমূর্তির অনেকখানি এখনো টিকে আছে। বর্তমানে এটি শ্রীলংকার একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র এবং বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। সেখানে একটি অত্যান্ত সুন্দর আধুনিক জাদুঘর রয়েছে। জাদুঘরটিতে রয়েছে শ্রীলঙ্কানদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানান নিদর্শন। সেই আদি জেলে জীবন থেকে বুদ্ধের ভাস্কর্য, অলংকার, পুতুল, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি। নানান দেশের দর্শক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন শ্রীলঙ্কানদের জীবন ও ঐতিহ্য।

এই পাহাড়ের অন্যপাশে বিরাট বিরাট পাহাড় রয়েছে। সামনের পাদদেশে সাধারণদের বসবাসের আবাস ছিল বলে ধারনা করা হয়। চারদিক এখন সুনসান নিরবতা। অনেক বড় বড় গাছের নিছে একজন একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ধ্যানরত অবস্থায় বসে রয়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পরে এক অন্য রকম অনুভূতি টের পেলাম। অনেক পানি পিপাসাও পেয়েছিল। ছোট পিঠব্যাগে পানির বোতল ছিল। আগে পানি খেয়ে নিলাম। তারপর কিছু ছবি তুললাম। অনেক র্দরের শহর দেখতে পেয়ে এক অন্যরকম আশ্চার্যবোধ অনুভব করলাম। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এক অপার বিস্ময়ে অভিভূত।