গরু/গোরু নিয়ে বিড়ম্বনা

মো. মোফাজ্জেল হোসেন

এক

প্রথমে একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ( ১৯২০ – ১৯৮৩, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতা) একবার তাঁর দাদা ঠাকুরের কাছে গিয়ে হাত জোড় করে বললেন,

‘দাদা ঠাকুর পেন্নাম হই।‘
দাদা ঠাকুর বিরক্ত হয়ে বললেন ‘পেন্নাম নয়, কথাটা প্রণাম।‘
ভানু এবার সতর্ক হয়ে বললেন ‘ভুল হয়ে গেছে’।
‘ভুল নয়, ভ্রম। এখানেও র ফলা লাগবে’।
‘বাব্বা, পেত্যেক কথায়র ফলা লাগবে?’
‘পেত্যেক নয়, প্রত্যেক। এটাতেও র ফলা লাগবে।‘
ভানু এবার বেশ জোরের সঙ্গে উত্তর দিলেন , ব্রেশব্রেশ।
দাদা ঠাকুর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন , ‘এটাতে র ফলা লাগবে না’। কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়দমবার পাত্র নয়। তিনি বললেন ,’না দ্রিমু য্রখন ত্রখন স্রবকটাতেই র ফ্রলা দ্রিমু।‘

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কী ভুল করেছিলেন ? তিনি তার ভাষার কথ্যরীতির আঞ্চলিক রূপ ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তার দাদা ঠাকুর শব্দের জাত চেনাতে লেখ্য রীতির সাধু রূপ শুনতে চেয়েছিলেন। সমস্যাটা মনে হয় এখানে।

ভাষা মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা যা অর্থবাহী বাকসংকেতে রূপায়িত (বাগযন্ত্রের মাধ্যমে ধ্বনিভিত্তিক রূপে বা লৈখিক রূপে) হয়ে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং একই সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। ভাষাকে যদি ধরি বহমান ঝরনা হিসেবে, তাহলে তার স্বাভাবিক চলমানতায় বাধা হয়ে দাঁড়ানো ঠিক হবে না। সে উপলাকীর্ণ পথ পেরোবে নিজের স্বচ্ছন্দ ধারায়। এঁকে যাবে, বেঁকে যাবে তবু আপন শক্তিতে সে খুঁজে নেবে নদীর বুক, তারপর বিলীন হবে মহাসমুদ্রে। বাংলাভাষার ক্ষেত্রেও তাই। ভাষা চলতে চলতে এবং বহুলোক কর্তৃক ব্যবহারের ফলে তার শব্দের ভিতরের ধ্বনিসমূহে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে। কিছু ধ্বনির আগমন ঘটে আবার কিছু ধ্বনি লোপ পায়।

দুই

গরু গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত প্রাণী। আমাদের মানব সমাজে একজন আরেকজনকে গরু বলে গালি দিলে বা ব্যঙ্গ করলেও ভারতের কিছু অঞ্চলে ধর্মীয় কারণে গরুকে গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। কেউ কেউ গরুকে ধনসম্পদের প্রাচীনতম গঠন বিবেচনা করেন।

বর্তমানে গরু নিয়ে যতটা আলোচনা হচ্ছে, ২০১৬ সালের আগে এতোটা আলোচিত হয় নি। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির উচ্চারণ অভিধানের ১২২ পৃষ্ঠায় গরু লেখা হয়েছে এবং ব্যাবহারিক বাংলা অভিধানেও গরু লেখা আছে। কারণ সংবৃত উচ্চারণ। অ-ধ্বনি উচ্চারণ ‘ও’-এর মতো হলে তাকে সংবৃত উচ্চারণ বলে। অন্যভাবে বলা যায়, অ-ধ্বনি উচ্চারণকালে ঠোঁট গোলাকৃতি হয় বলে একে সংবৃত উচ্চারণ বলে। যেমন: অধীন/ওধিন, মন/মোন, স্রষ্টা/স্রোশটা, শ্রাবণ/স্রাবোন ইত্যাদি। ই/ঈ/উ/ঊ-কারের আগের ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: কবি (কোবি), নদী (নোদি), মরু (মোরু), বধূ (বোধু), জননী (জনোনি), উপকূল (উপোকুল), অণু (ওনু), গরু (গোরু), কদু/কোদু, ছোট (ছোটো), প্রিয় (প্রিয়ো), যাবতীয় (যাবতিয়ো)।

২০১৬ সালে সর্বজন শ্রদ্ধেয় জামিল চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমি বাংলা বানান অভিধানে ২৪৬ পৃষ্ঠায় লেখা আছে ,গোরু/ (গাভি,গোজাতি) দ্র. গোড়ু

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান ৪১৮ পৃষ্ঠায় লেখা আছে গোরু/গেরু/(স-গোরূপ>)বি-১ দুটি শিং লম্বাটে মাথা গুছিবদ্ধ লেজ ও মসৃন লেজাবৃত দেহ বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী তৃণভোজী(এবং পূনঃপূন জাবর কাটে) গৃহপালিত চতুষ্পদী জন্তু।

তিন

বাংলা ভাষায় বানান জটিলতা নিয়ে ত্যক্ত বিরক্ত কেউ কেউ বানান ‘সংস্কার’এর কথা বলে থাকেন। তাদের যুক্তি হলো, বাংলায় বিভিন্ন শব্দের ‘বিচিত্র’ বানান মনে রাখাটা বিরাট এক ঝামেলার ব্যাপার। হ্রস্ব ই-কার, দীর্ঘ ঈ-কার, হ্রস্ব উ-কার, দীর্ঘ ঊ-কার, স, ষ, শ, জ, য, ন, ণ, ত, ৎ এসব প্রতীক ও বর্ণের ব্যবহারে ভাষা লিখতে গেলে বেশির ভাগ মানুষ জট পাকিয়ে ফেলে। শুদ্ধ বানানে বাংলা লেখা সম্ভব হয় না। প্রতীক আর বর্ণের এ বৈচিত্র্য এবং শব্দের বানানে তার ব্যবহার প্রথম প্রথম ভাষা লিখতে আসা যে কোনো শিক্ষার্থীর কাছেই জটিল মনে হতে পারে। তারা বানানও ভুল করতে পারে। তবে ক্রমাগত ব্যবহার ও চর্চার মধ্য দিয়ে তা একসময় আত্মস্থ হয়ে যায়।

ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজারের উপরে ভাষা আছে। পৃথিবীর এই প্রতিটি ভাষার দুটি করে রূপ আছে একটি লেখ্যরূপ ও অন্যটি কথ্যরূপ। অর্থাৎ মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে, হয় বলে নয়তো লিখে। এর বাইরে ঈশারায়ও মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে। মনে রাখা প্রয়োজন লেখ্যরূপের সাথে বর্ণ জড়িত আর কথ্যরূপের সাথে ধবনি জড়িত। তার মানে আমরা যা লিখি তা অনেক ক্ষেত্রে হুবহু উচ্চারণ করি না। আবার যা উচ্চারণ করি তা হুবহু লিখি না। শব্দ উচ্চারণের লিখিতরূপ হলো বানান তবে শব্দের উচ্চারণ ও লিখিতরূপ এক নাও হতে পারে। যেমন: অণু (ওনু,) কবি (কোবি), বধূ (বোধু), স্বাগতম (শাগোতোম), পদ্ম (পদদো), আত্মা (আৎতা), সমাস (শমাশ) ইত্যাদি। তবে প্রায় নির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমেই এমনটি হয়ে থাকে। বর্ণানুসারে যদি বানান করতে যাই তাহলে বানান বিপর্যয় হবে। শব্দের উৎপত্তিগত কারণে শব্দের বানান ও উচ্চারণ এক না। শব্দ বানাতে প্রয়োজন হয় বর্ণ ও বর্ণচিহ্ন আর উচ্চারণে প্রয়োজন হয় ধ্বনি। ধ্বনি উচ্চারণে প্রয়োজন হয় বাগযন্ত্র। উচ্চারণের উপর অক্ষর নির্ভর করে। অনেকে বর্ণকে অক্ষর হিসেবে বিবেচনা করেন যা ঠিক নয়। শব্দের খণ্ডাংশকে অক্ষর বলে। ভৌগোলিক অবস্থানভেদে মানুষের রুচি ও প্রয়োজনিক কারনে একটি বাচনিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে উচ্চারণ বলে।

চার

প্রত্যেক ভাষারই বানানের নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। এই নিয়ম সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছুটা আধুনিক করা হয় । যখন কোন ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে স্বরবর্ণ যোগ করাহয় তখন তাকে বানান বলে। ভাষা শুদ্ধরূপে লিখতে হলে সে ভাষার বানান জানা জরুরী। একই শব্দের একাধিক বানান বিভ্রান্তিকর ও শ্রুতিকটু। সমোচ্চারিত বর্ণ প্রায় প্রতিটি ভাষাতেই আছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত ভাষা ইংরেজিতেও রয়েছে। `C’, `Q’ এবং `K’ বর্ণ তিনটি বাংলায় ক-এর মতো উচ্চারিত হয়। ‘G’ গ-ও হয়, আবার কোনো সময় জ-ও হয়। প্রথম প্রথম তো আপনি বুঝেই উঠতে পারবেন না, ‘U’ বর্ণটার উচ্চারণ কখন ’আ’, কখন ‘উ’ আর কখন ‘ইউ’ হয়? নিয়মিত শিখন এবং চর্চার মধ্য দিয়েই সেটা আপনার কাছে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে ওঠে। বানান লিখতে গেলে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, পরিপূর্ণভাবে ধবনি অনুযায়ী বানান লেখার নিয়ম বিশ্বের কোন ভাষায় নেই। আমাদের ভাষার সব বর্ণ ধবনির প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু সব বর্ণই আমাদের লিখন পদ্ধতির আশ্রয়।কাজেই উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখা বিভ্রান্তিকর। বাংলা বানান সংস্কারের প্রথম দায়িত্ব দেয়া হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে। ১৯৩৫ সালে গঠিত হয় বাংলা বানান সংস্কার কমিটি ।১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় বাংলা শব্দের বানানের নিয়ম । পরবর্তী সময়ে বাংলা বানানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ও বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ড দায়িত্ব পালন করে । বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম (১৯৯২, সংশোধিত সংস্করণ ২০০০, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০১২)প্রচলন করে।

পাঁচ

বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’-এর একটিমাত্র পদে ‘গরু’ শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায়: ‘উমত সবরো গরুআ রোষে’ (চর্যা: ২৮)। অন্য কোন পদে এর উল্লেখ নেই। তবে এটি গরু না গুরু তা বলা মুশকিল। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ আছে ‘নান্দের ঘরের গরু রাখোআল’। মধ্যযুগীয় বাংলায় বিদ্যাপতি লিখেছেন ;’গিরিসম গরুঅ মান’। এখানেও গরু নাকি গুরু তা বুঝা মুশকিল। মালাধর বসু লিখেছেন গোরূ। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ১৬০০ সালের পুঁথিতে পাওয়া যাচ্ছে, ‘ধান্য গোরু কেহ নাঞি কেনে’। শ্রীযুক্ত মৃত্যঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার কর্তৃক ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের নিমিত্তে রচিত প্রবোধ চন্দ্রিকাতে বলা আছে ‘ এ বেটা গরু চন্দ্রমুখ পদ্মহস্ত ইত্যাদি স্থলে গরু চন্দ্র পদ্মা দ্বিশব্দ স্বস্বতুল্যকে লক্ষণাতে কহে।‘ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) বানানে ‘গোরু’ আছে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ‘গোরু’ লিখেছেন। ১৯২৯/৩০ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও (১৮৬১-১৯৪১) গোরু লিখতেন পরে নাকি তিনিও আবার গরু লেখেন। তার মানে হলো ব্যাক্তি বিশেষে কেউ গরুঅ, কেউ গেরু , কেউ গরু,কেউ গোরু , লিখেছেন। এটি তো আদর্শ হতে পারে না।

বানানে ত্যক্ত বিরক্তরা দেখি অবলীলায় সংস্কারের কথা তুলে বসেন। অতীতে বানান সংস্কারের কিছু অত্যুৎসাহী চেষ্টা করা হয়েছিল । একবার দেশের একটি পত্রিকারসম্পাদক নিজের পত্রিকায় ঋ-কার বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। ‘ক্রিকেট’কে ‘কৃকেট’, ‘প্রিয়’কে ‘পৃয়’, ‘ফ্রি’কে ‘ফৃ’ লিখতে শুরু করেছিলেন। ব্যাপারটা একটা উপদ্রবের মতো শুরু হয়েছিল। বাংলা বানান ছোটখাট হলেও একটা টর্নেডোর মধ্য দিয়ে গিয়েছিল তখন। এখন যেমন ফেসবুকে বাংলা বানানের উপর দিয়ে আম্ফান ঝড় বয়ে চলেছে।

সংস্কৃতিতে ‘য়’ নাই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) য-এর নিচে বিন্দু বসিয়ে তৈরি করলেন ‘য়’ যা ‘অ’ ধ্বনির মতো না। সংস্কৃতের ‘নিযম’ বাংলা হলো ‘নিয়ম’। প্রাকৃত বা চর্যাপদেও ‘য়/য়া’ নাই আছে ‘অ/আ’।এখন এই অন্তস্থ-য দ্বারা প্রতিস্থাপনে বাংলা ভাষার কি গুরুতর সমস্যা হয়েছে? বিংশ শতাব্দীতে এসে বলা হলো, আমাদের উচ্চারণে দীর্ঘ ঈ, দীর্ঘ ঊ, মূর্ধন্য-ণ নেই, মূর্ধন্য-ষ নেই । শব্দের জাত চেনানোর জন্য ‘সংস্কৃত’ ও ‘অসংস্কৃত’ বলে বদলে দেওয়া হলো বাংলা শব্দের বানান।আমাদের দীর্ঘ ‘ঈদ’ হয়ে গেল হ্রস্ব ‘ইদ’।বাংলা ধ্বনি পদ্ধতিকেএকেবারে অবহেলা করা হলো।

ছয়

গরুর ব্যুৎপত্তি মূলশব্দ ‘গো’ । অভিধান বলছে গো – (সংস্কৃত, গম+ ও)/ গোরু/গরু(সংস্কৃত গরূপ) অর্থ হলো জ্ঞান ঐশর্য, ধনু গাভী ষাঁড়, বৃষ,নিরেট, বোকা প্রভৃতি। এখন প্রশ্ন হলো যদি ‘গো’- ই থাকে তাহলে গরুর দরকার কী? ‘গো’ দিয়েই তো গরু বোঝানো যায়। আমরা তো গোধূলি, গোবেচারা বলি তাই না? কাজেই কোন ব্যক্তি বিশেষে কে, কী লিখলেন তার উপর নির্ভর না করে আমাদের দেশের বাংলা একাডেমি বা অন্যান্য বৃহৎ বিদ্যা প্রতিষ্ঠান বাংলা বানানে ভূমিকা রাখতে পারেন।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়েই শেষ করি। তাঁকে ইংরেজিতে (PILLAR) বানান করতে বললে তিনি উত্তরে বলেছিলেন একটা L দিলেই হয় কিন্তু দুটি L দিবেন তাতে (PILLAR) একটু পোক্ত হবে।