কবি সুফিয়া কামালের বিখ্যাত কবিতার চারটি

আজিকার শিশু

আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেল।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।
উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা
আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জিন ,পরী, দেও, দানা।
পাতালপুরীর অজানা কাহিনী তোমরা শোনাও সবে
মেরুতে মেরুতে জানা পরিচয় কেমন করিয়া হবে।
তোমাদের ঘরে আলোর অভাব কভূ নাহি হবে আর
আকাশ-আলোক বাঁধি আনি দূর করিবে অন্ধকার।
শস্য-শ্যামলা এই মাটি মা’র অঙ্গ পুষ্ট করে
আনিবে অটুট স্বাস্থ্য, সবল দেহ-মন ঘরে ঘরে।
তোমাদের গানে, কল-কলতানে উছসি উঠিবে নদী-
সরস করিয়া তৃণ ও তরুরে বহিবে সে নিরবধি
তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি-ডাকা রাঙা ভোর
জগৎ করিবে মধুময়, প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতিডোর।

 

 

কালের যাত্রার ধ্বনি

কাল কভু চুপ নাহি রয়,
কথা কয়, সে যে কথা কয়।
সে আবার জেগে ওঠে প্রত্যহের জীবন-স্পন্দনে;
সে দুর্বার প্রাণবেগে বেঁচে ওঠে নিত্যের স্মরণে।
দুর্জয় শক্তিতে তার কীর্তি লেখে যুগের প্রাচীরে
শতাব্দীর সাক্ষ্য রাখি, দিবস-নিশীথ-বক্ষ চিরে
গতি চলে তার,
তার সাথে ছন্দ রেখে চলে সিন্ধু নদী পারাবার।
কত প্রভাতের সূর্য হেসে আসে বাড়াইয়া কর,
হেলে পড়ে শোণিতাক্ত দীপ্ত দ্বিপ্রহর,
শোকাচ্ছন্ন অপরাহ্ন আসে,
নিশীথের সুপ্তি ভাঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে ভয়ে অবিশ্বাসে।
তারও পরে আসে সেই দিন
মৃতের কঙ্কাল পরে জেগে ওঠে জীবন নবীন।
বিলুপ্ত প্রত্যাশা কাঁপে শক্তিরূপে বক্ষের পঞ্জরে
সে মূর্ত প্রতীক হয়ে আযাদীর তরে
শতাব্দীর রুদ্ধ দ্বার আঘাতে আঘাতে করি চুর
বন্দীত্ব শৃঙ্খল ভাঙ্গা ধ্বনি শুনে অতি সুমধুর।
শোণিত উচ্ছ্বাসি ওঠে, শিরায় শিরায় জাগে সাড়া,
কোটি কণ্ঠে বেজে ওঠে উদাত্ত গম্ভীর সেই ‘নারা’।
বিদ্যুৎ চমকি যায় শিহরণ লাগে তীব্র বেগে
বজ্রের আরাবে মেঘে মেঘে
নির্ঘোষিয়া স্বর প্রসারিয়া কর
ঊর্ধ্বে তুলি উড়ায় পতাকা
শ্বেত-শ্যাম অর্ধ চন্দ্র-পূর্ণতারা আঁকা।
শান্তি সাম্য সেবা মৈত্রী ঘোষিয়াছে প্রসারিয়া হাত
কওমী হেলাল আজ দীনি-জমহুরিয়াত!
শানের জলুস চলে রাজপথে দৃপ্ত সুগম্ভীর মহিমায়,
নিত্যকার সূর্য তার সুপ্রসন্ন কিরণ ছড়ায়।
আ-সমুদ্র হিমাচল গিরিদরী বনানীর পারে
তৌহীদের মন্ত্র বাজে ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে।
ওড়ে একই ঝা-ার প্রতীক,
সর্বকালে সর্বদেশে সর্বদিগ্বিদিক
যে জাতি দিয়েছে পাড়ি,
গড়িয়া তুলেছে নিজ দেশ,
ক্ষুদ্র তুচ্ছ ভেদাভেদ করিয়া নিঃশেষ,
মহান ধর্মের সিংহদ্বার
মুক্ত করি রাখিয়াছে, মিলনের মহা-পারাবার
গড়িয়াছে মানুষে মানুষে,
দিয়াছে আসন সব, মানুষের সব জাতিধর্ম-নির্বিশেষে,
যারা মুক্তি লাগি
গড়েছে বাঁশের কেল্লা, যে মহান ত্যাগী
মুক্তির অমৃত ফল করেছে সন্ধান-
যত মহা মানবের প্রাণ
অলক্ষ্যে রহিয়া তারা কালের যাত্রার ধ্বনি শুনি
হেরে নাকি সেই সঞ্জীবনী।
লভিয়াছে তাহাদের উত্তর সাধক
কালের কুটির কক্ষে অবরুদ্ধ ছিল যে আলোক
তাহার এনেছে প্রাণ, দুর্গমেরে করিয়াছে জয়
কাল কভু চুপ নাহি রয়-
কথা কয় সে যে কথা কয়।

 

হেমন্ত

সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?

আনল ডেকে মটরশুঁটি,
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।

সকাল বেলায় শিশির ভেজা
ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।

আরও এল সাথে সাথে
নুতন গাছের খেজুর রসে
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা
মিষ্টি রোদে খেতে বসে।

হেমন্ত তার শিশির ভেজা
আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়
চুপে চুপে রং মাখাল
আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।

 

 

তাহারেই পড়ে মনে

“হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”

“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? -শুনি নাই,রাখিনি সন্ধান।”

কহিলাম “ওগো কবি, রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি।”
কহিল সে মৃদু মধুস্বরে-
“নাই হ’ল, না হোক এবারে-
আমার গাহিতে গান! বসন্তরে আনিতে ধরিয়া-
রহেনি,সে ভুলেনি তো, এসেছে তো ফাল্গুন স্মরিয়া।”

কহিলাম “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”
কহিল সে পরম হেলায়-
“বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নি সে অর্ঘ্য বিরচন?”

“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরি আসি-
“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”