কবি মহাদেব সাহার তিনটি কবিতা

চিঠি দিও

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই

ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।

চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও …
বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!

আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ….
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! …

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,

টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি !

 

মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস

কেউ জানে না একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস
নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষণ্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি
অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!
দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল
আর কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর ও তুষারাবৃত!
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে
কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ, তার চেয়েও বিষণ্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।
তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস
চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;
মানুষের বুকের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস, জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস
আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মানি-ক
দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুস তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে;
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়,
হায়, কেউ জানে না!

 

এই ব্যর্থ আ-কার এ-কার

এই তো আমার কাজ আ-কার এ-কারগুলো খুঁটে খুঁটে দেখি যদি হয়,
যদি কিছু হয়
যদি একটি পাখিরও মৃদু ঠোঁট হয়ে ওঠে নিরুপায় শিথিল
অক্ষরে
চোখের অধীর অশ্রু যদি কাঁপে এ-কারের ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে
আমি তা জানি না; আমি শুধু অবিচল মুদ্রাকরের মতন
কালিঝুলি-মাখা এই কেসের ভিতরে সারাক্ষণ চালাই
আঙুল।
এই তো আমার কাজ আ-কার এ-কারগুলো জড়ো করি
আর ভেঙে ফেলি
কখনো ঘনায় মেঘ কখনোবা রঙিন সূর্যাস্ত নেমে আসে
টাইপের এই জীর্ণ কেসের গহ্বরে
কখনো একটি ভাঙা আ-কার খুঁজতে গিয়ে দেঝি তার গায়ে কতো রহস্যের
রাঙা স্পর্শ লেগে আছে, এ-কার কখনো দেখি তন্ময়ের
তীরে একা-একা,
আমি তবু ভাঙি আর জড়ো করি এই ব্যর্থ বর্ণের ব্যঞ্জনা।
মাঝে মাঝে আমিও কখনো হয়ে উঠি রোমাঞ্চিত যদি দেখি
একটিও সফল আ-কার কোনোখানে বসিয়েছি ঠিক,
আর তাই তো কখনো আমি পড়তে দিইনি ধুলো এই কালো
এ-কারে আ-কারে
তারা যেন ক্ষেতের সোনালি পাকা ধান, থোকা থোকা
পড়ে থাকা জুঁই!
আমি এই অসহায় চিহ্নগুলোকে নিয়েই হয়তো বানাতে
চাই ব্যাকুল বাগান
হয়তো ফোটাতে চাই তারই ডালে প্রত্যাশার গাঢ় স্বর্ণচাঁপা
এমনও হয়তো আমি তারই মাঝে ফুটিয়ে তুলতে চাই
জ্যোৎস্নার নিবিড় জড়োয়া!
এই তো আমার তুচ্ছ কাজ আ-কার এ-কারগুলো তুলি আর
তুলি ভেঙে ফেলি
দেখি যদি হয়, যদি কিছু হয়
কোনো মুখ, কোনো নাম, কোনো প্রিয় স্মৃতির রুমাল
যদি হয়, যদি কিছু হয় একটি আ-কার জুড়ে দিলে
সেই বিস্ফারিত চোখ, জলাশয়, চিত্রিত হরিণ
কিংবা পর্যটনের পাখিটি;
তাই তো এমন মনোযোগে
এতো রাশি রাশি অক্ষরের ফাঁকে বসিয়েছি এই ভালোবাসার
এ-কার
আ-কার তখনো বাকি আমি ভাবি বুঝি আ-কার এ-কার
জুড়ে দিলে
অনায়াসে হয়ে যাবে তোমার প্রকৃতি
তাই তো মেখেছি এতো কালিঝুলি এই হাতে, এই দুটি
হাতে!
যদি হয় এই ব্যর্থ আ-কার এ-কারগুলো তুলে কোনো মগ্ন
মাটির বারান্দা
পাতার ছাউনি আর গ্রিলের লতানো নিশ্চয়তা যদি হয়
একখানি ঘরোয়া ইমেজ;
সেই ভেবে রেফ আর অনুস্বরগুলো প্রায় ছুঁইনি আঙুলে
কেবল পরেছি এই আহত কপালে আমি অকারণ বিস্ময়ের ফোঁটা
আর মাঝে মাঝে প্রশ্নের দরোজাখানি খুলে ডেকেছি তোমাকে
যদি হয়, যদি কিছু হয় এই আ-কার এ-কারগুলো থেকে
রঞ্জিত বা গূঢ় উচ্চারিত!