আরিফুর রহমান

অন্ধকারেও দেখা যায়


আহা কোনো রমণী যদি আমার হতো?

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কারো হাত ধরে বসে থাকি, বাইরে ঘুরতে যাই দুজনে মিলে। কিন্তু আমার স্বপ্ন চিরকাল স্বপ্নই থাকবে কারণ আমি জানি আমি রমনীদের সঙ্গে মেলামেশায় পটু নই। তারপরেও আমি প্রীতি করিমের দিক থেকে আমার চোখ ফেরাতে পারিনা, কেন জানিনা তাকে দেখলেই মনের মধ্যে একটা জলতরঙ্গের মূর্ছনা তৈরী হয়। এটাও সত্যি প্রীতি করিম কোনদিন আমার মতো একটা লোকের সাথে প্রেম করবেনা। কখনো কোনো সুন্দরীকে দেখে আমার আপন করে পেতে ইচ্ছে করেনি, কখনো কোন মোহও জাগেনি; হয়তো আমার অন্ধকার জীবনের জন্য, আমার আগের বাজে অভিজ্ঞতার কারণে, আরো অনেক বাজে কিছু দেখে। সর্বোপরি আমার জীবন হলো রমনীহীন জীবন।
কিন্তু প্রীতি করিম কে? আসছি সে কথায় –

আমার নাম বিক্রম মোল্লা। আমি জানি না আমার এই নাম কে দিয়েছিল, বাবা-মা কে ছিল তাও জানি না। কিন্তু পার্টি অফিসে আমার বিক্রম নিয়ে প্রশ্ন করবার সাহস কারো নেই। কারণ আমি একজন পেশাদার খুনী এবং অরুন চৌধুরী, বর্তমান উন্নত দেশ পার্টির চেয়ারম্যানের বডিগার্ড। পার্টির কেউ জানেনা আমি তার আদেশে গোপনে মানুষ খুন করে থাকি; কিন্তু দলের সবাই জানে সরকার বিরোধী আন্দোলনে আমি কিভাবে অরুন চৌধুরীকে রক্ষা করেছি। সামনের নির্বাচনে সবাই ধারণা করছেন তিনি বিজয়ী হবেন এবং দেশের প্রধান হবেন। এর পেছনে অবশ্য আছে পার্টির কিছু নিবেদিতপ্রান নেতা। তার মধ্যে উজ্জ্বলতম হচ্ছেন সেই প্রীতি করিম। তার পিতা আহমেদ করিম যদিও সরকারী দল করেন কিন্তু তিনি তার দলে এখন একজন পড়ন্ত নক্ষত্র, স্বাধীনতা যুদ্ধে অসীম সাহসী ভূমিকার জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় স্বীকৃতি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন কোনো আদর্শ নেই, আছে কেবল মিথ্যার অলঙ্করণ আর নিজের স্বার্থসিদ্ধি পূরণের আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু এর মধ্যে ব্যাতিক্রম হচ্ছে প্রীতি করিম। তার কাছে এটা শুধু ক্যারিয়ার চয়েস না; তার চেয়েও অনেক বড়, তাকে দেখলে মনে হবে এটা তার জীবনের ব্রত। দেবী টাইপের যত বিশেষণ আছে যত মহাকাব্যে, তার সব গুণাবলী রয়েছে প্রীতির মধ্যে । অসম্ভব সুন্দরী, সেলফ-সাক্রিফাইসিং, দয়ালু, বিনয়ী, সবার জন্য ভালোবাসা, সবার যত্ন, খোঁজখবর এমনকি প্রত্যেক স্থানীয় নেতা ও কর্মীর কারো কোনো ছোট সমস্যা সব কিছুর মধ্যে প্রীতি আছে । নিজে সে ডাক্তার, আমরা কোনো জেলায় বা উপজেলায় গেলে দেখতে পাই তার কাছে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু তার কোনো অহমিকা নেই, খুবই নিপাট এবং আপনার জন সে। তাদের জীবনের দুঃখ, বেদনার গল্প শোনা কিংবা তাদের জীবনের স্বপ্ন কি ছিল তা নিয়ে আলাপ করা। এবং কি করলে সবার ভালো হবে তা নিয়ে সব সময় সে আলোচনা করে। আমি জানিনা এতো প্রাণশক্তি তার কথা থেকে আসে, কিন্তু আমি যখন নিজেকে তার সাথে তুলনা করি- আমি যেন সেখানে এক নরকের কীট । এর থেকে আমার নিজের জীবন নিয়ে আমি ভাবতে চাই, আমার মনের সাতকাহন, বন্ধ গলি, অন্ধকার চিন্তা শুধুই আমাকে পীড়া দেয় আমি কি এক অশরীরী শয়তান।

হঠাৎ করে কোনো কোনো সময় রাতের বেলা মনে হয় আমার বেডরুমের ভিতর বিশাল বড় এক লরি ঢুকে বিছানার পাশে পার্ক করে দাঁড়িয়ে আছে। তার ডিজেল ইঞ্জিনের ভয়াবহ শব্দ বাজতেই থাকে যতক্ষণ না আমি বিছানা ছেড়ে না উঠি। আবার বিছানার আরেক ধারে নৈঃশব্দ আমাকে গ্রাস করে, ক্রমশ ভয় বাড়তে থাকে কারণ আমার সারাটা জীবন কেটেছে নানারকম আতঙ্ককর কন্ঠস্বর আর নৈশব্দের মধ্যে দিয়ে।

আবার আমার ভাবনার বেড়াজালে বিরাজ করে প্রীতি নামের এক দেবদূত। আমার কেবল মনে হয় আমি যদি পেতাম তাকে? তাকে মানে প্রীতির মতো একজন রমণী – সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। ছোট করে ছাঁটা কালো রঙের চুল, উন্নত গ্রীবা, হালকা গড়ন, মোহনীয় হাঁটার ভঙ্গী, ঠোঁট যেন গোলাপের মতো লাল, রাজহাঁসের মতো ঘাড়, চোখ যেন বিস্ময় দৃষ্টি দিয়ে বুঝে নেয় সবকিছু, আরও আছে যা তার সম্পর্কে বলা শেষ করা যাবে না। সে আমার মতোই বয়সী, সবে মাত্র চল্লিশে হয়তো পা দিয়েছে। আমার কাছে মনে হয় প্রীতি যেন আমার দিকেই চেয়ে থাকে যদিও আমি জানি মেয়েদের স্বপ্নপুরুষের যে যে গুনাবলির দরকার তার কিছুই নেই আমার মধ্যে। কিন্তু আমার তার কাছে কাছে থাকতে ভালো লাগে, ভালো লাগে তার শরীরের উষ্ণতা আর সুমিষ্ট ঘ্রান। তার শরীরের উজ্জ্বলতা আমার কাছে সূর্যরশ্মির মতো লাগে। তার চলার ছন্দ যেন জাহাজের মতো এবং সত্যি সত্যি আমার মনে হয় আমার এই বঞ্চিত হৃদয়ের স্বপ্ননায়িকা হচ্ছে প্রীতি করিম ।

সবার মাঝেই কোনো না কোনো গুন্ আছে, আছে মেধা এবং সবার অধিকার আছে অন্যকে সম্মান করার। আর মানুষ হিসাবে এভাবে চিন্তা করাটাই যুক্তিযুক্ত। আবার সেখানে আছে কিছু পচনশীল মানুষ, সন্দেহ নাই আমি তাদের একজন। আমি সবকিছুই দেখি আলাদা করে, মাথার মধ্যে কিলবিল করে নোংরা ভাবনা আর মানুষের ভালো থাকাটা যেন আমার কাছে বিরাট এক যন্ত্রনা। কিন্তু আবার একই সাথে আমি অনুভব করি ভালো থাকার সুতীর্ব্র আখাঙ্খা। মাঝে মাঝে আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি, সবকিছু মনে হয় উলটপালট করে ফেলি।

কিন্তু এর মধ্যে আছে প্রীতি করিম, মানুষের মধ্যে একজন দেবী। কোনসময় যখন সে পার্টি অফিস দিয়ে হেঁটে যায়, আমার নিজেকে খুব দুর্বল আর ভঙ্গুর মনে হয়. কিন্তু আমি জানি প্রীতি করিমের গোলাপি লাল ঠোঁটে চুমু খাবার যে আনন্দ তা কোনোদিন আমার হবে না, আমার বেশ ভালোই জানা আছে এই ভালোবাসার বাণিজ্য।

পার্টি অফিস ধানমন্ডি সাত নম্বরের শেষ মাথায়। আমি থাকি পার্টি অফিসের পাশের বাড়িটায় যেটা অরুন চৌধুরীর নিজের বাড়ি । আফনান হলো অরুন চৌধুরীর ড্রাইভার, তার সাথে আমার বেশ সখ্যতা। সুযোগ পেলেই সে চলে আসে আমার নির্জন কামরায় যেটা অরুন চৌধুরীর বাড়ি পেরিয়ে ঠিক বাগানের পেছনটায়। অনেক পুরোনো বাড়ি, অনেক জায়গা নিয়ে। তবে সামনের অংশটুকু তিনি আধুনিক করেছেন, বাংলোর মতো – মাঝে মাঝে তিনি বিদেশী রথী-মহারথীদের সাথে সেখানে মিটিং মিছিল করেন আর পেছনের অংশে মানে বাগান পেরিয়ে আমার জন্য এই কামরা রেখেছেন। তিনি বেশির ভাগ সময়ই গুলশানে থাকেন আবার মাঝে মাঝে কোনও দরকার পড়লে এখানেও থাকেন। তবে সে দরকারের লম্বা ফিরিস্তি আছে।

আজ পার্টি অফিসে তেমন কেউ নেই, আমি চলে আসলাম আমার কামরায়। আমার কামরার সাথে লাগোয়া একটা ছোট রান্নাঘর আর টয়লেট আছে। অরুন চৌধুরী আজ আসেননি, তার শরীর খারাপ। নির্বাচন নিয়ে চারিদিকে বেশ শোরগোল চলছে। আফনান পিছে পিছে চলে আসলো। বললাম কি ব্যাপার কি চাও?
বস একটা বোতল আছে, খাবেন নাকি?
আমি রাগত চাহনি দিয়ে বললাম – কি সেটা ?
ভদকা -গ্রে গুজ, গাড়ির বুটে পেলাম, মারাত্মক জিনিস এবং অনেক দামী। আচ্ছা বস, স্যার এসব খায় নাকি?
আমি জানি না আফনান, তুমি খেলে খাও। আমার ক্ষিদে লেগেছে – কিছু একটা খেতে হবে।
বস একটা গ্লাস দিবেন, ফ্রিজে কি কোকাকোলা আছে?
বসো, আমি দেখছি।

আফনানকে বসিয়ে রান্নাঘরে আসলাম, তাড়াতাড়ি কি খাওয়া যায় তাই চিন্তা করছি। অনেকদিন নুডুলস খাই না – পানি গরম দিলাম চুলায়। ফ্রিজ খুলে একটা কোলা ক্যান পেলাম। রান্নাঘর থেকে উঁকি দিলাম লিভিং রুমে। দেখি আমার ওয়ালেট থেকে দুইটা পাঁচশ টাকার নোট নিয়ে নিজের পকেটে চালান করে দিলো আফনান। মুহূর্তেই সমস্ত বোধশক্তি হারালাম আমি। হাতের কাছে একটি হাতুড়ী পেলাম, বেধড়ক মারলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার রাগ কমলো। পুরো লিভিং রুম ভেসে গেছে রক্তে। লাশটিকে নিয়ে আসলাম আমার কামরার পেছনে, তারপর রুম পরিষ্কার করা শুরু করলাম। চেক করলাম কোথাও কোনো রক্তের দাগ আছে নাকি। লাশটিকে কবর দিতে হবে, কোদাল যেন কোথায় দেখেছি। পিছনে জংলী ফুলের মাঝখানে লাশটাকে লুকালাম, মাটিতে রক্তের দাগ গুলি ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এই সময় ডাক শুনতে পেলাম

বিক্রম বিক্রম !

আমার খুব পরিচিত এবং প্রিয় কণ্ঠস্বর এবং যার জন্য সারাটি সময় আমি অধীর হয়ে থাকি, কিন্তু এমন সময় সে কেন এলো? তাড়াতাড়ি রুমের ভিতরে চলে আসলাম, চারিদিকে ভালোমত দেখে নিলাম কোথাও কোনো আছে কিনা যা আফনানের উপস্থিতি জানান দিবে, গ্রে -গুজের বোতলটি দেখতে পেলাম কিন্তু এখন আর সময় নেই পদক্ষেপ অনেক কাছে চলে এসেছে।

এই বিক্রম – তোমাকে কতক্ষন ধরে খুঁজছি, তুমি অফিস থেকে কখন এলে? আমার কল্পদেবী প্রীতি করিম আজ আমার সামনে তাও আবার আমার কামরায়। কেমন যেন উত্তেজনা ভর করলো।
নাহ, দেখলাম কোনো কাজ নেই, একটু ক্ষিদে লেগেছিলো তাই ভাবলাম কিছু একটা খেয়ে আসি।
ওহ আচ্ছা, তুমি ঠিক আছো।
জি, ম্যাডাম আমি ঠিক আছি, আপনি?
আমি ভালো আছি, আচ্ছা আফনানকে দেখেছো?
নাতো!
কে যেন বললো তোমার সাথে দেখেছে – তাই ভাবলাম তোমাকে জিজ্ঞাসা করে দেখি?
হুম, আমরা একসাথেই বের হয়েছিলাম কিন্তু ও যেন কোথায় চলে গেলো।
কিছু বলেছে – কোথায়, ফোনেও পাচ্ছিনা- ফোন বন্ধ।
আমি জানি না ম্যাডাম।
ঠিক আছে, তুমি থাকো, আমার একটু গুলশান যেতে হবে – ভাবলাম আফনান আমাকে নামিয়ে দিতে পারবে নাকি।
ওহ আচ্ছা, আমি কি কোনো ট্যাক্সি বা কোনো কিছু ডেকে দিবো?
নাহ, অসুবিধা নেই – আমি একটা উবার ডেকে নিবো। আচ্ছা যাই। বলে বিদায় নিলো প্রীতি করিম।

আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। লাশটাকে কবর দিলাম। তারপর আবার হাত ধুয়ে নুডুলস বানিয়ে খেয়ে নিলাম। গ্রে -গুজের বোতল খুলে সবটুকু এলকোহল সিঙ্কে ঢেলে দিলাম আর তারপর বোতলটিকেও মাটি চাপা দিলাম।


ধানমন্ডি লেকে আমি মাঝে মাঝে সকাল বেলা আসি। কালকের ঘটনা নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই, আমি জানি আমার কিছু হবে না কারণ অরুন চৌধুরীদের আমাকে দরকার তাদের ক্ষমতা আর কদর্য লালসা মেটানোর জন্য। দেখলাম মীম আর তার মা বেলা এসেছে। মীমকে দেখে আমার বলবার কিছু নেই, প্রকৃতির এ এক অমানবিক খেলা। ছোট্ট বাচ্চারা থাকবে পুতুলের মতো – দেখলেই আদর করতে মন চাইবে কিন্তু ওকে দেখে উল্টো তার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য হবে সবাই। তার চোখ যেখানে থাকবার কথা সেখানে নেই, হাতগুলি শরীরের তুলনায় বেঢপ আর এতো ফিনফিনে শরীর আমি মনে হয় কোথাও দেখিনি। গায়ের রং ফর্সাটে কিন্ত সে রংয়ে কোনো ঔজ্বল্য নেই – সে স্বভাবতই হাঁটতে পারেনা- হুয়িল চেয়ার তার সারা জীবনের সাথী। মীম কথা বলতে পারেনা, কেবল পাখির মতো কিচিরমিচির করে। সে আর তার মা বেলা প্রায়ই আসে এই লেকে – আমার মতো। বেলার বয়স বেশি নয় – সুগঠিত শরীর, খুব একটা অসুন্দর নয় সে কিন্তু তার জীবন মনে হয় এরকম ছন্নছাড়া থাকবে। আফনান আমাকে বলেছিলো যে বেলা ধানমন্ডি সাত নম্বর রোডের একটি বাড়িতে থাকে এক বয়স্ক মহিলার সাথে, দেখাশুনা করে। সেই মহিলার ছেলে নাকি এই মীমের বাবা। যদি কেউ আসেও তার সুগঠিত শরীর দেখে কিন্তু আমি নিশ্চিত বেশিদিন থাকবে না – এর কারণ অবশই মীম। আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা তাই বলে। আমি নিজের সম্পর্কে সন্দিহান কিন্ত অন্য মানুষ দেখলে বুঝতে পারি কি হতে পারে। আমি জানি আমি স্বাভাবিক নই কিন্তু যারা দেশ চালাচ্ছে তারা আরো বেশি অস্বাভাবিক – সব কিছু চলছে এক অদৃশ কালো হাতের থাবায় – নৈরাজ্যে ভরা সম্পর্ক আর লোক দেখানো চাকচিক্য অসম এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত পুরো সমাজ ।

আমার ভালো লাগে এই পার্কে এসে বসে থাকতে- আরো ভালো লাগে লোকজন দেখতে। তাদের একেক জনের কেমন চলাফেরা – কেমন জীবন তা বুঝতে পারাটা আমার কাছে একটা খেলার মতো মনে হয়। সামনে বহমান লেকের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি আমি এমন কেন। আজকেও বসে বসে দেখছি মানুষের আনাগোনা। মীম আর তার মা বেলাও আছে। আমি তাকালাম তার দিকে – সেও তাকালো আমার দিকে। কি যেন বলতে চাই সে – হয়তো বলতে চায় এই জীবন আমি চাইনা – আমার জীবনের সব সমস্যা দূর হোক – আমি চাই অন্য এক জীবন – সুন্দর এক জীবন।

হয়তো সবাই চাই এক অন্য জীবন – সুন্দর এক জীবন !

ফোন বেজে উঠল আমার, দেখলাম বস অরুন চৌধুরী ফোন দিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করলেন কোথায়।
বললাম আমি ধানমন্ডি লেকে।
তাড়াতাড়ি চলে আসতে বললেন।
পৌঁছে গেলাম অফিসে। বুঝলাম খুব একটা ভালো মুডে নেই তিনি।

আফনানকে পাওয়া যাচ্ছে না, কাল থেকে। শেষ নাকি তোমার সাথে দেখা গেছে। আমাকে বলো কি হয়েছে। শুস্ক গলায় জানতে চাইলেন অরুন চৌধুরী।
তার কামরায় আমি ছাড়া কেউ নেই।
সরি বস, আমি দেখিনি তাকে।
সত্যি করে বলো, তুমি জানো আমি ছাড়া তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা। আর নির্বাচনের আগে আমি কোনো ধরনের গন্ডগোল চাই না। আমাকে বলো কি হয়েছে আফনানের।
আমি বললাম সব কি হয়েছিল।
কিছু বললেন না তিনি, সব শুনে কিছুক্ষন চুপ থাকলেন তারপর বললেন ঠিক আছে আমি দেখছি কি করা যায়। তুমি যাও এখন।

আমি জানি, তিনি এখন কি করবেন। সবকিছু ধামাচাপা দেওয়া হবে, আফনান নামের একজন ব্যক্তির অস্তিত্ব উবে যাবে মুহূর্তেই।

নির্বাচনের সময় কাজ বেশি থাকে। নির্বাচনী এলাকায় প্রচরণা চালানোর জন্য তার সাথে ঘুরতে হবে সারা দেশময়। প্রীতি করিমও যাবেন আমাদের সাথে কিন্তু সব জায়গায় নয়। কাল আমরা যাবো রংপুর, এটা অরুন চৌধুরীর নিজস্ব এলাকা। এখানেই দাঁড়াবেন তিনি। সরকার দলের প্রার্থীর অবস্থানও বেশ শক্ত। বিভিন্ন মিডিয়া ধারণা করছে বেশ ভালো লড়াই হবে এখানে। সার্কিট হাউসে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

খুব সকালে রওনা দিলাম আমরা, আমি বসের গাড়িতে কিন্তু সামনের সিটে। পেছনের গাড়িতে আছেন প্রীতি করিম। আজকে যেন তার কথা মনে পড়ছে আমার কিন্তু তিনি যেন আমাকে আর পাত্তাই দেন না।

কয়েকটি পথসভা হোল, ভালোই জনসমাগম হয়েছে। অরুন চৌধুরী খুব আশাবাদী।

আমরা পৌঁছে গেলাম সার্কিট হাউসে। কালকে বিকালে শহরের কেন্দ্রে প্রধান জনসভা আর তারপর ঢাকা ফেরার পথে কয়েকটি পথসভা করবেন।

আমি থাকবো অরুন চৌধুরীর পাশের কামরায়। আর অন্য দিকের পাশের কামরায় থাকবেন প্রীতি করিম আর অনান্য নেতা-কর্মীরা।

রাতে খাওয়ার আগে তিনি সবাইকে ডেকে মিটিং করলেন এবং সবকিছু দেখে নিলেন, কে কখন বক্তব্য রাখবেন এবং বক্তব্যের ধরন আর বিষয়। কিছু খুঁটিনাটি আলোচনা করলেন। আমি এখনও নিশ্চিত নই আমার এখানে কোনো ভূমিকা আছে নাকি মানে হিটম্যান হিসাবে। পেশাদার খুনী শব্দের চাইতে হিটম্যান শব্দটি আমার কাছে ভালো লাগে।

খাওয়ার পর্ব শেষ করে আমার রুমে চলে আসলাম। বেশ সুন্দর মনোরম পরিবেশ, আকাশে চাঁদ। ভাবলাম একটু হাঁটি। বাইরে ঠক ঠক আওয়াজ আসছে, অরুন চৌধুরীর দরোজায়। দেখতে পেলাম একটি নারী মূর্তি – মনে হলো যেন প্রীতি করিম। কিন্তু এতো রাতে প্রীতি করিম কেন অরুন চৌধুরীর কামরায় আসবে। অরুন চৌধুরীর নারী আসক্তি আছে কিন্তু প্রীতি করিমের সাথে অসম্ভব। আমার মাথার ভেতর কেমন রক্ত খেলে গেলো, আমি জানি এটা কিসের সংকেত। নিজেকে সংহত করার চেষ্টা করলাম।

পাশের কামরা থেকে নারী কণ্ঠের আর্তচিৎকার ভেসে এলো, জোরালো আওয়াজ নয় কিন্তু আমার জন্য যথেষ্ট। আবার মাথার ভেতর রক্ত খেলে গেলো কিন্তু এবার অনেক জোরে। আমি দরজা ভেঙে ফেললাম অরুন চৌধুরীর। মাতাল অরুন চৌধুরী প্রীতি করিমের শাড়ি খোলায় ব্যস্ত। মদের বোতল দিয়ে বাড়ি মারলাম অরুন চৌধুরীর মাথায়। তারপর মেরেই চললাম যতক্ষণ পর্যন্ত আমার রাগ না কমে।

পুলিশ এলো, আমার হাতে হাতকড়া পরালো। আমার মাথা কাজ করছেনা মনে হচ্ছে একটি ডিজেল ইঞ্জিনের ট্রাক আমার মাথার কাছে ঘড়ঘড় করছে। পুলিশ ভ্যানে উঠার আগে উপরের দিকে চাইলাম – দেখলাম প্রীতি করিম আমার দিকে চেয়ে আছে আর তার মুখে একটি রহস্যময় হাসি। আমি বুঝে গেলাম কি হবে আমার – কারন আমি অন্ধকারেও দেখতে পাই।