আখতার উদ্দিন মানিক

কালীগ্রাম পরগনার কৃষক নেতা কমরেড বৃন্দাবন সাহা স্মরণে

ব্রিটিশ যুগের শেষ প্রান্তে এসে বাংলার সকল জমিদারই শোষণ নির্যাতনের সকল সীমা অতিক্রম করেছিল। এই আলোচনায় যে জমিদারের প্রসঙ্গ এসেছে তা হলো বর্তমান বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার অনতর্গত কালীগ্রাম পরগনার ঠাকুর জমিদার। যার মূল শিকড় কোলকাতার সুবিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। কালীগ্রাম পরগনার সদর কাছারী পতিসরে ছিল জমিদারীর সদর কাছারী। পতিসরে অবস্থান করে জমিদারীর খাজনা আদায়, প্রজাদের শাসন করা, অবাধ্য প্রজাদের বশীকরণের জন্য বরকন্দাজ বাহিনী নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যাদি সম্পন্ন করতেন জমিদার রথীন্দ্রনাথ ঠকুরের মামা শ্রীনগেন্দ্রনাথ রায়। তিনি দীর্ঘকাল এই পতিসরে হেড ম্যানেজার হিসেবে কালীগ্রাম পরগনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। মূলতঃ প্রজা পীড়নের সর্দার হিসেবে তার ভূমিকাই ছিল সর্বাধিক। খাজনা আদায়, তহুরী কর আদায়, হিতৈষী তহবিল আদায়, এছাড়াও আরও বহুবিধ কারণে প্রজাগণ নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। প্রজা অসন্তুষ্টি, ক্ষোভ আর হতাশার কারণে নেত্র প্রশস্ত ছিল। প্রজাদের অন্তরভূমি শুকনো খড়কুটোর মতো শুধুমাত্র অগ্নি সংযোগের অপেক্ষায় ছিল। আর এই গুরুদায়িত্ব পালনে প্রতিবাদ কণ্ঠস্বর রূপে যারা ভূমিকা রেখেছিল তাদের মধ্যে কমরেড বৃন্দাবন সাহা ছিলেন এই অঞ্চলের সবচেয়ে উজ্জল ব্যক্তিত্ব।

বৃন্দাবন সাহা ছিলেন কালীগ্রাম পরগনার জমিদার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা এবং অগ্নিপুরুষ। তার বাড়ি ছিল বর্তমান রানীনগর উপজেলার বাঁশবাড়ীয়া গ্রামে। পিতার নাম কার্তিক সাহা, মা বাদুলী রানী সাহা। জন্ম ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে। তিনি নিজের পরিচয় লিখেছেন এভাবেÑ ‘১৯১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার জন্ম। জন্ম তারিখটি আমার খেয়াল নেই। সংসারে ৮ জন লোক। বাবা মা ছাড়াও কাকা হরিবরণ সাহা (বাবার বৈমাত্রেয় ভাই), দিদি খান্তমনি সাহা, বড় দাদা কালীচরণ সাহা, সেজদাদা বলরাম সাহা, আমি বৃন্দাবন সাহা, আমার ছোট বোন মতি সাহা। বাবা কৃষি কাজ করতেন। তিনি খাটি কৃষক ছিলেন।’
তিনি নিজ বাড়ি থেকে চার মাইল দূরবর্তী রাতোয়াল গ্রামের রাতোয়াল মাইনর স্কুলে পড়াশুনা করেন। মেট্রিকোলেশন পাশ করে তিনি গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। শৈশব থেকে সামাজিক কর্মকান্ড এবং খেলাধুলায় বিশেষ ঝোক ছিল। প্রাইমারী স্কুলে বেতন পেতেন মাসিক চার টাকা। এছাড়াও বিভিন্ন বাড়িতে গৃহ শিক্ষকতা করেছেন। তিনি গ্রামের লোকদের দলিলপত্র লিখে দিতেন। তিনি বাঁশবাড়ীয়া, গহেশপুর, তিলাপুর, পলিশা তেজনন্দী প্রভৃতি গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক ছিলেন বিভিন্ন সময়। শৈশব থেকে তিনি সামাজিক কর্মকান্ড এবং স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। শৈশব থেকে সঙ্গীত চর্চা করতেন। পরবর্তীতে স্বদেশী গান গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের তিনি মুগ্ধ করেছিলেন। বিভিন্ন কারণে তিনি প্রাইমারী স্কুলের কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি নওগাঁর গাজামহলে হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। প্রথমে ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। কালীগ্রাম পরগনার জমিদার বিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি খদ্দরের টুপি পরে বিদেশী কাপড় পোড়ানোর আন্দোলনে যোগদান করেন। ‘বিদেশী জিনিস বর্জন করো’ আন্দোলনে যেয়ে তিনি ৬মাস জেল খাটেন। তিনি কালীগ্রাম পরগনার জমিদার বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন। তিনি বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে কৃষক সমিতির সদস্য সংগ্রহ করতেন। বিভিন্ন গ্রামে তিনি প্রজা কমিটি গঠন করে জমিদার বিরোধী আন্দোলন জোরদার করে তোলেন।

আন্দোলন দমন করার জন্য পরগনার জমিদার জোর জবরদস্তি করে খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে বরকন্দাজ নামক একটি ভয়াবহ ঠাঙারে বাহিনী গঠন করা ছাড়া বোধ হয় তাদের আর কোন বিকল্প ছিল না। এই বরকন্দাজদের জমিদারী স্টেট হতে তেমন বেতন-ভাতা দেওয়া হতো না। তবে তাদেরকে অবাধে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল প্রজাসাধারণ থেকে জোর র্পূবক অর্থ আদায় করে নিজেদের বেতন-ভাতা পুষিয়ে নিতে। বরকন্দাজগণ প্রজাদের থেকে যে অর্থ আদায় করতো তাকে বলা হতো ‘রোজ’। জমিদার কাছারী থেকে নোটিশ নিয়ে গেলে প্রজা থেকে ‘রোজ’ নেয়া হতো। মামলার শমন জারী করলে তার জন্য প্রজাদের থেকে ‘রোজ’ নেওয়া হতো। এই বরকন্দাজগণ প্রজাদের ফল-ফলাদী এবং হাঁস-মুরগী থেকে শুরু করে তাদের পছন্দসই যে কোন জিনিস তারা প্রজাদের থেকে জোর করে আদায় করতো। প্রজাকে ধরে আনা, লাঠি পেটা করা, পাদুকা প্রহার করা ইত্যাদি ছিল তাদের নিত্যকার কাজ। গায়ে-গতরে শক্তিশালি এবং দুর্বৃত্ত প্রকৃতির লোকদের বরকন্দাজ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো। এই বরকন্দাজগণ সবসময় তেলে পাকানো বাঁশের লাঠি সঙ্গে রাখতো। সকল বরকন্দাজ সমান মাপের চার হাত লম্বা লাঠি রাখতো। এ ছাড়া বল্লম, বর্শা ও তরবারী মালখানায় প্রস্তুত থাকতো, তবে তা ব্যবহারের তেমন প্রয়োজন পড়তো না। বাঁশের লাঠিই ছিল যথেষ্ট।

কালীগ্রাম পরগনার প্রজাগণ অধিকাংশই ছিল অতি দরিদ্র। দূর্বল শারীরিক সামর্থ্য নিয়ে তারা যুগ যুগ ধরে জমিদারের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার। যথা সময়ে জমির খাজনা পরিশোধ না করে কোন উপায় ছিল না। দেরি হলে জুটতো বরকন্দাজের নির্মম প্রহার আর চূড়ান্ত অপমান-অপদস্তি। কখনো কখনো প্রজাদের মধ্যে কেউ কেউ শত চেষ্টা করেও বা কোন ধার কর্য করেও খাজনার টাকা জোটাতে না পারলে পালিয়ে যেতো। কিন্তু পালিয়ে যাবে কই? বরকন্দাজগণ যে ভাবেই হোক তাকে ধরে আনবেই। খাজনা পরিশোধে অক্ষম প্রজার নাম তালিকাভূক্ত হয়ে যেতো তহশিলদারের নিকট। তহশিলদার এই পলাতক প্রজার তালিকা বরকন্দাজের নিকট হস্তান্তর করতো। অথবা পরের মাসেই ঐ গ্রামে তহশিলদার খাজনা আদায় করতে আসলে দিতে হতো সেলামী, উপহার-উপঢৌকন ইত্যাদি। আর বরকন্দাজের হাতের লাঠি পেটা, পাদুকা প্রহার বা দৈহিক নির্যাতন থেকে রক্ষা পাবার জন্য এই সেলামী বা উপঢৌকনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হতো। আর ব্যর্থ হলে কঠিন শাস্তি জুটবে প্রজার কপালে। কমরেড বৃন্দাবন সাহা একটি নিষ্ঠুর ঘটনার উল্লেখ করেছেন তার প্রতিবেদনে। তবে এধরনের ঘটনা একটি দুটি নয় শতশত। বৃন্দাবন সাহা লিখেছেন-
‘এই রকম এক পলাতক প্রজাকে দুই বরকন্দাজ ধরার জন্য ধাওয়া করলে, সে দৌড়ে আমার বাড়ির পাশে প্রহ্নাদ প্রামাণিকের গোয়াল ঘরে এসে লুকায়। বরকন্দাজ দুটি চারিদিকে ঘর-দরজা তল্লাসী করতে করতে শেষে ঐ গোয়ল ঘর থেকে ঐ প্রজাকে টেনে বের করে, কিল, চড়, লাথি আর সেই তেল পাকানো লাঠি দিয়ে এমন ভাবে গুতানো, মারধোর শুরু করলো, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। বৃদ্ধ প্রজাটি মারের চোটে মাটিতে পড়ে গেলেও তাকে টেটে হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল কাছারীতে, তহশিলদারের নিকটে। পৌষ মাস। সমস্ত পুরুষ মানুষ চলে গেছে মাঠে ধান কাটতে। মেয়েরা অবাক হয়ে দেখতে লাগলো। আমি তখন পাশ করে সবে মাত্র ১ম শ্রেণিতে প্রমোশন পেয়েছি। আমিও হতভম্ব হয়ে যাই। তখনই আমার মনে হয় মানুষ হাল চাষ করে জমিতে ধান ফলায়, আর ঐ বরকন্দাজ কেন গ্রামে আসে আর মানুষকে মারে, টাকা নেয়। ঐ কাছারীতে কেন মানুষ যায় টাকা দিতে!

আগের কথা ফিরে যাই। লোকটিকে কাছারীতে ধরে রাখে। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে দেখতে পাই, বুড়ো লোকটিকে কাছারীতে ধরে রেখেছে। বুড়ো লোকটির স্ত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আমার স্বামীকে আর জীবন্ত পাবো না। তার উপর যে অত্যাচার হলো বা আরো হবে, সে মরেই যাবে। তার কান্না এবং কাকুতি-মিনতি দেখে পাড়ার কিছু লোক টাকা পয়সা যোগাড় করে, কাছারীতে ভয়ে ভয়ে যায়, কার কপালে কি আছে বলা নাই যায়! সকলে ক্ষমা চেয়ে সেই বুড়ো লোকটিকে ছাড়িয়ে আনে। প্রজাটির নাম জমরদ্দিন মন্ডল, গ্রাম বাঁশবাড়িয়া।

প্রজাকে শুধু জব্দ নয়, তার রক্তে বোনা ধান তছরূপ ও আত্বসাৎ করার জন্য অগ্রহায়ণ মাসে ধান পাকলে, তহশীলদার কাছারীতে এসে বরকন্দাজ বাহিনী নিয়ে মাঠে গিয়ে, জমির উপর দাঁড়িয়ে, ধান ক্রোক করা হলো – বলে ফতোয়া দিতো। প্রজা আর ফসলের মালিক নন্। মালিক হলেন তহশিলদার। তিনি ধান কাটিয়ে কাছারীতে তুলে ঝাড়াই-মালাই করে, বিক্রি দিয়ে ইচ্ছামত টাকা নিয়ে নমঃ নমঃ করে, দয়া করে, যদি কিছু প্রজাকে দেন, তাহলে বড়ই ভাল, নচেৎ রক্তে বোনা ধান সবই জমিদারের খাসে। প্রজার হিসাব চাইবার বা টু শব্দটি করার উপায় নাই।

গ্রামের মধ্যে উৎকৃষ্ট খাদ্য দ্রব্য, যা বরকন্দাজের নজরে পড়তো – ইচ্ছেমত নিয়ে যেতো, কোন বাধা বিপত্তি চলবে না। পুকুরের মাছ, তরিতরকারী, দুধ যা কিছুই হোক না কেন !

অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাকি খাজনার দরুন মামলার শমন গোপন করা হতো, যাতে প্রজা কোনরূপ তদ্বির করতে না পারে। এক তরফাভাবে জমিদার কর্মচারী কর্তৃপক্ষের নির্দেশানুযায়ী ডিগ্রী করে নিতো। ডিগ্রী করা মানে জমি খাস করে নেওয়া। প্রজাকে ঘুণাক্ষরে জানতে দেওয়া হতো না।’

কালীগ্রাম পরগনার প্রজারা দুরকম সরকার বা গভর্নমেন্টের অধীনে বসবাস করতেন। এক নম্বর ব্রিটিশ সরকার আর দুনম্বর জমিদার সরকার। ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে অনেকেই অনেক কাজ করতেন। থানা, দারোগা-পুলিশকে সেকালের মানুষ ভয় করতো। জমিদার বা তার প্রতিনিধি আমলাদের আরও বেশি ভয় করতো। জমিদারের সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক ছিল শোষক আর শোষিতের সম্পর্ক। যেমন সাপ এবং ব্যাঙের সঙ্গে সম্পর্ক, অথবা বলা যায় খাদ্য ও খাদক। তেমনি জমিদারের সঙ্গে প্রজার সম্পর্কও ছিল অনুরূপ। গ্রামের কাছারী, তহশীলদার ও বরকন্দাজদের দাপটে বড় করে কথা বলার ক্ষমতা কারো ছিল না।
বৃন্দাবন সাহার নেতৃত্বে কৃষক আন্দোল ক্রমান্বয়ে জোরদার হয়ে উঠলো। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে প্রতিবাদী কৃষক সমিতি, জমিদারের বরকন্দাজ বাহিনী আর গ্রামে যেতে সাহস করছে না। তহশিলদারগণ এবং জমিদারির আমলাকূল ভয়ে আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়েছে। জমিদারের বংশবদ কিছু গ্রাম্য প্রধান যারা পঞ্চপ্রধান নামে পরিচিত। তারা নিজেদের রক্ষার পথ খূজছে। তাই খোদ জমিদারকে আজ বড় বেশি দরকার। তাই পঞ্চপ্রধান এবং পদস্থ জমিদার কর্মচারীগণ মিলে খোদ জমিদারকে পরগনায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগলো। জমিদার রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসর কাছারীতে উপস্থিত হলেন। প্রজা কমিটি এবং কৃষক নেতারা প্রজাদের দ্বারা হাতে হাতে তাদের দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ ও আলোচনা করলেন।

স্মারকলিপিতে দাবি ছিল- (১) খাস জমি অবিলম্বে ফেরত দিতে হবে। ডিগ্রীর টাকা ১০ বৎসর কিস্তিতে শোধ হবে। (২) খাস পুকুর ফেরত দিতে হবে। তা হবে জনগণের পুকুর বা সম্পত্তি। প্রত্যেকে মাছ ধরে খাবে। (৩) তহুরী এবং হিতৈষী ফান্ড আদায় বন্ধ করতে হবে। জনগণ যে টাকা দিবে তারই দাখিলা দিতে হবে। (৪) কোন প্রকারেই জমির ধান ক্রোক করা চলবে না।

পরবর্তীকালে প্রজাগণ খাস জমি ফেরৎ পেতে থাকেন। খাস পুকুর অনেক স্থলে বংশবদ প্রজাদের পত্তন দেন জমিদার পক্ষ। প্রজাগণ দলবদ্ধভাবে সেই পুকুরে মাছ ধরতে শুরু করে। বশংবদ প্রজাও বাধ্য হয়ে ঐ পুকুর ছেড়ে দেয়। জমিদারের নিজস্ব পুকুরে পূর্ব হতেই প্রজারা সমবেত মাছ ধরতেন। খাস পুকুরে প্রজাদের অধিকার কায়েম হয় এইভাবে। হিতৈষী ফান্ড রহিত হয়। কৃষি ব্যাংকের টাকা কিস্তি মোতাবেক শোধ দিতে থাকে প্রজাগণ। এবং ব্যাংক কর্তৃক খাস জমিও ফেরৎ নিতে থাকেন।

কিছু প্রজা হিতৈষী ফান্ডসহ খাজনা দিতেই থাকে। সাধারণ প্রজাদের নিকট হতে খাজনা আদায় হচ্ছেনা দেখে তারাও কিছুদিন বাদে বন্ধ করে দেয়। জমিদার ৮জন কৃষক নেতাকে ধরে চক্রান্ত করে সম্মেলন ভেঙ্গে দিয়েছে। কিন্তু সাধারণ প্রজার মনোবল ভাঙ্গতে পারেনি। অটুট মনোবল নিয়ে তারা দাবি আদায় করেছেন।

জমিদারের বশংবদ কেউ কেউ অধীনস্ত গ্রাম্য সাধারণ পিছিয়ে পড়া প্রজাকে হাতে রেখে, খাস পুকুর ভোগ দখল করছিল। যেমন বাঁশবাড়িয়া গ্রামের যোগেন্দ্রনাথ সাহা, তার বাড়ির সঙ্গে খাস পুকুর নিজ দখলে রেখেছিল। মার্চ মাস ১৯৪৬ সাল গ্রাম্য প্রজারা জোট বেঁধে তাতে মাছ ধরে। সর্বসাধারণ প্রজাদের অধিকার কায়েম করে। এ ব্যাপারে কংগ্রেসের তরফ থেকে অনেক অন্তরায় সৃষ্টি করা হয় এবং তা প্রজাগণ ঐক্যবদ্ধভাবে দূরে হঠিয়ে দেয়।

এদিকে সমস্ত পরগনার প্রজাগণ বিজয় উৎসবের জন্য জেগে ওঠে। প্রস্তুতি হিসেবে জেলা কৃষক সম্মেলন করার জন্য সাড়া পড়ে যায়। সম্মেলনের স্থান ঠিক হলো এবার প্রজা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র দেউলা গ্রাম। ১৯৪৬ সালের মে মাস প্রকাশ্য সম্মেলনের পূর্বে প্রতিনিধি সম্মেলনে বিভিন্ন এলাকার রিপোর্ট দেখা গেল, খাস জমির পুকুরের শেষ শতকটুকুও প্রজাগণ ফেরৎ নিয়েছে। স্থানীয় কৃষকদের বহু আকাক্সিক্ষত, বগুড়ার কৃষক নেতা নছিরুদ্দিন মন্ডল সম্মেলনের সভাপতিত্ব করলেন। প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করলেন প্রাদেশিক কৃষক নেতা মনসুর হাবিবুল্লাহ। এই সম্মেলন একাধারে জেলা কৃষক সম্মেলন ও কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদের ফলপ্রসূ দাবি আদায় পুরোপুরিভাবে আদায় হওয়ায়, বিজয় সম্মেলন হিসেবে খ্যাত। যে সমস্ত খাস জমিওয়ালা প্রজার কোন ওয়ারিশ ছিল না, তাদের জমি আমলাপক্ষ নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেবার যে চক্রান্ত করছিল, তা সাধারণ প্রজারা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে বানচাল করে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত ঐ জমি ভূমিহীন দুঃস্থদের নামে পত্তন দেবার জন্য একদিকে আন্দোলন চলে, অন্যদিকে কৃষক সমিতির জেলা কমিটির তরফ হতে দু’একজন কৃষক নেতা যথাক্রমে- কমরেড সন্তোষ ভট্টাচার্য এবং কমরেড প্রমোদ লাহিড়ী শান্তিনিকেতনে গিয়ে জমিদার রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট ডেপুটেশন দিয়ে, ভূমিহীন দুঃস্থ পরিবারের মধ্যে পত্তন দেবার দাবি কায়েম করে নিয়ে আসেন।

এভাবে দীর্ঘ ৯ বৎসর কাল বৃন্দাবন সাহার নেতৃত্বে নওগাঁ জেলার অর্ন্তগত কালিগ্রাম পরগনায় আন্দোলন চালিয়ে সমস্ত দাবি দাওয়া আদায় হয় এবং আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু আন্দোলন আর বিদ্রোহের আগুন ছিল বৃন্দাবন সাহার রক্তে। তাই এক আন্দোলন সফলভাবে শেষ করে আর একটি আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। এবার তিনি রাজশাহী জেলার নাচোলের সাঁওতাল ও বাঙালী কৃষক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

তিনি নাচোলে ইলা মিত্রের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘকাল কারাবন্দী এবং বহু নির্যাতনের শিকার হন। বহুবার তিনি পাকিস্তান পুলিশের নির্মম অত্যাচারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। শরীর ভেঙ্গে যায়, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৫৯ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি অনিবার্য কারণে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। তবে আমৃত্যু নিজ মাতৃভূমির প্রতি তার ভালবাসা ছিল অকৃত্রিম। তিনি পশ্চিমবঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) এর একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মী এবং দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কমরেড মানবেশ চৌধুরী লিখেছেন ‘কমরেড বৃন্দাবন সাহা এদেশে আসবার পর, ১৯৬০ সাল থেকে প্রথমে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ও পরবর্তীকালে আমাদের পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত কুমারগঞ্জ থানা এলাকার একজন পরিশ্রমী, কষ্টসহিষ্ণু, নিবেদিত প্রাণ নেতা ছিলেন।’

তথ্যসূত্রঃ
১. মানবেশ চৌধুরী : কমরেড বৃন্দাবন সাহার জীবন-সংগ্রামের অমর কথা, যামিনী মজুমদার ভবন, বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ।
২. আখতার উদ্দিন মানিক : কালীগ্রাম পরগনার ঠাকুর জমিদার ও কৃষক গণ-সংগ্রামের ইতিহাস, গতিধারা, ৩৮/২ক, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, বাংলাদেশ।