হরিজন কলোনী
শহরের শেষ প্রান্তে যেখানে ময়লা ফেলা হয় তার পাশেই সরকারী জায়গায় একটি মেথর কলোনি আছে। এই মেথর কলোনীর ইতিহাস নাটোর শহরের গোড়াপত্তনের কয়েক বছর পরেই শুরু হয়। তখনকার দিনে ইংরেজ সাহেবরা এই দেশ শাসন করতো। ইংরেজ সাহেবরা যেখানে থাকে তার চারপাশ খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। ইংরেজ সাহেবরা এদেশের মানুষের মতো অপরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে না। পোশাক আশাকে তারা এদেশের মানুষের মতো ধুতি পাঞ্জাবী আর আলখাল্লা পরিধান করে না। ইংরেজ সাহেবরা যখন নাটোর শহরে আসে তখন তাদের বসবাসের আশেপাশের রাস্তা ঘাট, শহরের অলি-গলি এমনকি পয়োনিষ্কাশনের ড্রেনগুলা,রেলওয়ের স্টেশনগুলা পরিচ্ছন্ন করার জন্য ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিচু বর্ণের কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে এদেশে নিয়ে আসে। এদের কাজ ছিল সূর্য ওঠার আগে সাহেবদের জন্য রাস্তা-ঘাট ঝাড়ুদিয়ে পরিষ্কার করা
রেলের স্টেশনগুলোর পায়খানাগুলো পরিষ্কার করা এবং সাহেবদের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করা। এই মেথর কলোনিতে প্রায় পঞ্চাশ ঘর মেথর,ডোম,বাগদি পরিবার বাস করে। একটি পরিবারের জন্য একটি ঘর ।
বার ফুট দৈর্ঘ্য আর দশ ফুট প্রস্থেও সেই ঘরের মধ্যে ছেলে মেয়ে স্ত্রী বাবা মা সবাইকে নিয়ে বিশ্বজিৎ বাঁশফোড় এর বসবাস। বিশ^জিৎ পেশায় হরিজন।বিশ্বজিৎ বাঁশফোড় এর বাবা হরেন বাঁশফোড়ও ছিলেন মেথর। তার স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাতা সবাই এই পেশায় নিয়োজিত। হরিজন কলোনিতে যে পঞ্চাশ ঘর মেথর ও ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে তাদের সকলেই বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে। এদের মধ্যে আছে নরেন হাড়ি, কেদার বাগদি, নিমাই ডোম,নারায়ন ডোমারসহ আরো অনেকে। হরিজন কলোনির বিশ্বজিৎ মেথর সাহেবদের জন্য পায়খানা পরিষ্কার করে, রাস্তা পরিষ্কার করে কিন্তু এই কলোনিতে তাদের জন্য কোন আলাদা পায়খানার ব্যবস্থা নেই। পুরো কলোনিতে দুইটি পায়খানা। পঞ্চাশটি পরিবারের জন্য মাত্র দুটি পায়খানা ! এ যেন ঘরামির ঘরে কুটো না থাকার মতো অবস্থা। যারা শহরকে পরিষ্কার রাখে তাদের নিজেদের পরিষ্কার রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। এটাই কি ঈশ^রের বিধান?
এরা সকলে হিন্দু ধর্মের অনুসারী এবং সবাই শুদ্র গোত্রের অধিকারী হওয়ায় বিশ্বজিৎ বাঁশফোড়, নরেন হাড়ি,কোদার বাগদির ছেলেমেয়েরা পাশের মহল্লার ছেলেয়েদের সাথে একসাথে খেলতে পারে না। এমনি কলোনীর উত্তর পাশে বড় যে পুকুরটা আছে সেখানে এই কলোনীর কেউ স্নান করতেও পারেনা। এর কারণ একটাই। আর সেটা হলো বিশ্বজিৎ ,নরেন,হরেন এরা সকলেই দলিত শ্রেনীর মেথর। শহরের হিন্দু,মুসলিম বৌদ্ধ,খ্রিস্টান কেউ এদের সাথে কথা পর্যন্ত বলে না। আর্যদের করা জাতিভেদ প্রথার বিষবৃক্ষ আজও বিশ^জিৎকে বহন করে বেড়াতে হচ্ছে। হরিজন কলোনির পাশেই রয়েছে প্রভাবশালী বামন পাড়া। বামন পাড়ার পুরোহিত হরেকৃষ্ণ এলাকার সর্বজনীন কালি মন্দিরের সেবায়েত। মন্দিরের ফটকে বড় করে লেখা সর্বজনীন কালিমন্দির। ফটকে সর্বজনীন লেখা থাকলেও সেখানে হরিজনদের প্রবেশ নিষেধ। হরিজন কলোনির কেউ সেখানে পূজা দিতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে হরিজন কলোনির সকলে সূর্য পূজা করে। ঈশ্বরের পূজামন্দিরেও যেন সকলের প্রবেশের অধিকার নেই। ঈশ্বরকে সমাজের হরেকৃষ্ণরা ভাগ করে ফেলেছে। আমাদের জন্য সমাজে না আছে সম্মান না আছে অর্থ। এমনকি আমরা ঈরের পূজা করবো সেখানেও নানা বিধি নিষেধ। আমাদের ঈশ^র আর হরেকৃষ্ণদের ঈশ্বর যেন আলাদা। বিশ্বজিৎ কথাগুলো মনের দুঃখে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নরেন হাঁড়ির সাথে বলছিল। বিশ্বজিৎ এর কথা শুনে নরেন বলে,‘দাদা ঈশ্বর মনে হয় আমাদের মানুষের মর্যাদা মরণের আগে দিবে না। যদি তাই না হবে তাহলে আমরা কেন সমাজে মানুষের মর্যাদা পায় না। ঈশ্বরের দেয়া একই আলো-বাতাস, জল সকলেই ব্যবহার করছি অথচ একদল সমাজের উচু শ্রেনীতে আছে । যারা উচু শ্রেনীতে আছে তারা আমাদের মানুষও মনে করেনা। অথচ আমরা ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার না করলে এই উঁচু শ্রেণীর হরেকৃষ্ণরা একদিনও বাঁচতে পারবে না নরেনের কথা শুনে বিশ্বজিৎ বলে, তুমি ঠিক বলেছো নরেন। কিন্তু হরেকৃষ্ণরা কী কখনো আমাদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে দিবে? বাঁচতে হলে দরকার শিক্ষা। আর ওরা তো আমাদের শিক্ষার অধিকার সবার আগে ছিনিয়ে নিয়েছে।
বিশ্বজিৎ বাঁশফোড় এর সংসারে স্ত্রী,দুই পুত্র ও বাবা-মা আছে। দুই ছেলে হরিশ ও নরিশ ছাড়া সকলে ভোররাতে উঠে রাস্তা পরিষ্কার এর কাজে বেরিয়ে যায়।খুব ভোররাতে সকলে যখন ঘুমায় বিশ্বজিৎ বাঁশফোড়ের পরিবারের লোকজন তখন শহরকে পরিষ্কার করার জন্য ব্যস্ত থাকে। রাতেও যে শহরে নানা ধরনের অপকর্ম আর খারাপ কাজ হয় সেটা দেখার জন্য বিশ্বজিৎরা কাজে আসে না। বাধ্য হয়ে তাদের অনেক ঘটনা দেখতে হয়।
বিশ্বজিৎ চোখের সামনে অনেক ঘটনা দেখে। কিন্তু কোনদিন কাউকে কিছ’ বলতে পারে না। এই বলতে না পারার পেছনে রয়েছে নিজের জীবনের নিরাপত্তা। বিশ্বজিৎ বাঁশফোড় যেন ঈশ্বরের এমন একজন সৃষ্টি যে চোখের সামনে অনেক কিছু দেখে,কান দিয়ে অনেক কিছু শোনে কিন্তু কাউকে সে কথা বলতে পারে না। বিশ^জিৎ যেন চোখ থাকতেও অন্ধ আর কান থাকতেও বধির। যা হোক বিশ্বজিৎ এর দিন এভাবে শুরু হয়। সকাল আটটার মধ্যে সকলে কাজ শেষ করে ঘরে ফেরে। সারাদিন বিশ্বজিৎ ও স্ত্রী তৃপ্তি ঘরে শুয়ে-বসে থাকে।
আবার অনেকে কলোনির মধ্যে গল্প-গুজব করে। গল্প বলতে হরিজনদের নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা। স্ত্রী তৃপ্তি বাঁশফোড় চায় না তাদের দুই ছেলে তাদের মতো মেথর হিসেবে জীবন পার করুক। স্বামী বিশ^জিৎও চায় তাদের সন্তানরা সমাজের উচুতলার মানুষের মতো লেখাপড়া করে চাকুরী বাকুরী করে হরিজন কলোনী ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাক। এসব কথা তৃপ্তি বাঁশফোড় তার স্বামীকে বলছিল। বিশ্বজিৎ তৃপ্তিকে বলে, তুমি তো চাও ছেলেরা বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক। আমিও তোমার মতো চায়। কিন্তু হরিশ-নরিশের জন্য স্কুল কোথায় পাবো? এখানকার স্কুল তো তাদেরকে ভর্তি নিবে না। এখানকার স্কুলে তো হরিজনদের ভর্তি করা নিষেধ।
হরিজোন কলোনির মানষের সামাজিক জীবনও আশেপাশের এলাকার হ্ন্দিু,মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের থেকে অনেক আলাদা। নরেন, কেদার নারায়ন এদের মধ্যে শিক্ষার কোন আলো কখনো প্রবেশ করেনি। তাই বাইরের জগতের কোন কিছু নরেন,বিশ^জিৎ ও নারায়নদের কাছে পরিচিত নয়। বিশ্বজিৎ বাঁশফোড় দুঃখ করে স্ত্রী তৃপ্তিকে বলে আমাদের জীবন কেন এমন? আমরা কী ঈশ্বরের অভিশপ্ত সন্তান? তবে হরিজোন কলোনীতে বিনোদনের কোন অভাব নেই্। এদের বিনোদন মানে একসাথে বসে নারী পুরুষ সকলে টেলিভিশন দেখা, লুডু খেলা, নিজেদের মতো করে নাচ-গান করা। শহরের কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়া তাদের নিষেধ। এখানে ছেলে বুড়ো কে কার সাথে কী নিয়ে খোশগল্প করে সেটা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। সবাই যেন সবার ঘরের মানুষ। হরিজন কলোনিতে যেন সবাই সবার আত্মীয়। এই অবাধ মেলামেশার সুযোগে কারো কোন পারিবারিক গোপনীয়তা বলতে কিছু নেই। এটা নিয়ে তৃপ্তি মাঝে মাঝে বিশ্বজিৎ এর সাথে নানা কথা বলে। সে এসব অবাধ মেলামেশা পছন্দ করে না। তৃপ্তি মনে মনে চায় তাদের এই অবাধ মেলামেশা যেন না থাকে কিন্তু তার কথার মূল্য বোঝার মতো কী কোন ব্যবস্থা হরিজন কলোনীতে আছে? একদিন বিকেল বেলা বিশ্বজিৎ ঘরে ছিল না। এই সুযোগে নারায়ন ডোমার তৃপ্তির ঘরে ঢোকে। সে তৃপ্তিকে জোর করে অশালীন কাজ করতে বাধ্য করে। তৃপ্তি নারায়নকে যতভাবে পারে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সে নারায়নকে রুখতে পারে নি। আসলে শারীরিক আর মানুষিকভাবে নারীজাতি পুরুষের চেয়ে অনেক দুর্বল। আর তৃপ্তি চিৎকার চেঁচামেচি করলে উল্টো সবাই তৃপ্তির চরিত্র নিয়ে তাকে কলঙ্কিত করতো। নারায়নের ব্যবহারে তৃপ্তি এতটাই ভেঙ্গে পড়ে যে সে কারো সাথে ঘটনাটা বলতে সাহস পায় না। নিজের সাথে নিজে মনোযুদ্ধে হেরে যায়। সে নিজের কষ্ট নিজের মধ্যে রাখতে পারে নি। সে রাতের বেলা বিশ্বজিৎ এর কাছে নারায়ন ডোমার এর এই অসভ্যতামীর কথা বলে।
বিশ্বজিৎ সব কথা শুনে তৃপ্তিকে বলে, এই কলোনীতে যারা আছে সবাই তো আমার ভাই। আমাদের পূর্ব পুরুষরা এমন করেই তো জীবন পার করেছে। এটা আবার আমাদের কাছে এমন কী।তুমি দেখ না নরেন হাড়ি, কেদার বাগদি,নিমাই ডোম সবাই তো সবার ঘরে যায় কেউ কখানো অভিযোগ করেছে? যদি তুমি অভিযোগ কর তুমি কী পারবে হরিজন কলোনীতে থাকতে? আর সমাজের সাহেবরা দেখ না লাল গাড়িতে করে শহরের হোটেল গুলোতে যায়, নানা রকম রঙ্গরস করে। আমরা তো আর অন্য জাতের সাথে ঢলাঢলি করি না। যা কিছু করি মেথরদের মধ্যে। হরিজন কলোনির সামাজিক জীবন এটাই। তাদের মধ্যে সব পুরুষের রয়েছে একাধিক স্ত্রী। মদ খাওয়া তাদের যেন জন্মগত অধিকার। সরকার বাহাদুরও যেন বিশ্বজিৎদের মদ খাওয়া জুয়াখেলার বৈধ লাইসেন্স দিয়েছে। পারিবারিক কলহ যে একেবারে নেই তা বলা যাবে না। তবে তাদের সকলের পারিবারিক কলহ যেন ইদুর বিড়ালের মতো খেলা। সকালে গন্ডগোল তো বিকেলে একসাথে বসে তাস খেলা। হরিজন কলোনির প্রত্যেক পুরুষই দিনের বেলা মদের নেশায় ডুবে থাকে। কে যে কী কথা কখন কাকে বলে সেটা নিজেরা পরে মনে করতে পারে না। এটাকে মেথর পল্লী না বলে একটা মদ পল্লী বলা যায়।
বিশ্বজিৎ তার ছেলে নরিশ-হরিশকে স্কুলে ভর্তি করতে চায়। সে একদিন শহরের একটি সরকারী স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যায়। সেই স্কুেেল হেডমাস্টার শ্রীবাসুদেব মন্ডল। প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ এর কাছে তাদের বংশ পরিচয় জাত পাত সবকিছু জানতে চায়। বিশ্বজিৎ প্রধান শিক্ষককে সবকিছু খুলে বলে। সে প্রধান শিক্ষককে বলে আমি আমার সন্তানদের পড়ালেখা শেখাতে চায়। আমি চায় ওরা যেন মানুষের মতো মানুষ হয়। আমার মতো যেন ওরা হরিজন না থাকে। প্রধান শিক্ষক সবকথা শুনে বিশ্বজিৎ তোমার সব কথা তো শুনলাম। তুমি যদি সত্যিই সন্তানদের মঙ্গল চাও,তোমাকে আপন পরিচয় পরিবর্তন করতে হবে তুমি কী পারবে সেটা? বিষয়টি আমাদের দুজনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীকেও বিষয়টি বলতে পারবে না। যদি তুমি রাজী থাকো আমাকে বলো, আমি সব ব্যবস্থা করে দিব। বিশ্বজিৎ অনেক ভেবে বিষয়টিতে সম্মতি জ্ঞাপন করে। নরিশ ও হরিশ বাঁশফোর এর নাম রাখা হলো নরিশ মন্ডল ও হরিশ মন্ডল। হরিশ ও নরিশের স্কুল যাত্রা শুরু হলো। তবে সেটা মিথ্যা পদবী দিয়ে। প্রায় ছমাস এভবে চলতে থাকে। প্রথম সমাপনী পরীক্ষায় নরিশ ও হরিশ প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। এবার স্কুলে বোমা বিস্ফারিত হলো। স্কুলের সভাপতি বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য এর একমাত্র কন্যা পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছে। নরিশ ও হরিশের ভালো ফলাফল করা যে তাদের জন্য কাল হবে সেটা হয়তো ঈশ্বরও চিন্তা করতে পারে নি। বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য খোঁজ নিতে শুরু করেন কে এই নরিশ ও হরিশ? সে যখন জানতে পারে নরিশ ও হরিশের বাড়ি হরিজন কলোনীতে তখন তো তার মাথায় বাজ পড়লো। হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। বিষ্ণুপদ স্কুল কমিটির সদস্যদের কাছে জানতে চাইলো এই স্কুলে কী করে হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলেরা ভর্তি হলো? কেউ কোন জবাব দিতে পারে না। এবার তিনি অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর পিতামাতাকে নিয়ে হরিশ নরিশকে স্কুল থেকে বের করে দিতে চাইলেন। কিন্তু কেউ বেশি সাড়া দিল না। প্রধান শিক্ষক উদার মানুষ। তিনি বিষ্ণুপাদ বাবুকে বললেন,বাবু ঈশ্বর তো সব মানুষকে সমান করে তৈরী করেছেন। হয়তো পেশায় কেউ শিক্ষক,কেউ কামার-কুমোর,সেবায়েত। বাবার পেশা ও পদবীর জন্য আমরা একজন ছাত্রকে স্কুল থেকে বের করে দিতে পারি না। প্রধান শিক্ষকের কথা শুনে বিষ্ণুপদ যেন কিছুটা হোচট খেল। তিনি আর বেশি কিছু বললেন না। ঘটনা যা ঘটার সেটা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। পুরো স্কুলের সকল ছাত্র ছাত্রী জেনে গেছে নরিশ-হরিশ মেথরের ছেলে।এখন নরিশ-হরিশ যখন স্কুলের বারান্দায় যায় সবাই তাদেরকে দেখে বলে,ঐ দেখ মেথরের ছেলে যায়। কেউ তাদের দুই ভাইয়ের সাথে কথা বলে না, নানা ভাবে তাদেরকে স্কুলও স্কুলের বাইরে উত্যক্ত করে। দিনে দিনে নরিশ-হরিশের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠে। একসময় ছোট বাচ্চা দুটি স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। নরিশ-হরিশ মেথরের ছেলে হওয়ার জন্য তাদের শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি হলো। এটাই হলো হরিজন পল্লীর বাইরের সমাজ ব্যবস্থা। নরিশ –হরিশ বাধ্য হয়ে একসময় হরিজন পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করবে। একদিন এই ছেলে দুটিও কী তাদের সন্তানদের হরিজন করে তুলবে। কেউ কোনদিন এই কথা বলবে না যে নরিশ হরিশ একসময় স্কুলের সেরা ছাত্র ছিল। যে সমাজে বংশপরিচয় দিয়ে মানুষের সবকিছু নির্ধারিত হয় সে সমাজ কী কখনো সভ্য সমাজ হতে পারে?নরিশ-হরিশদের কথা কী কখনো ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকে? নিশ্চয় না। তাদের জীবনের কাহিনী লেখা থাকে কান্নার নীল হরফে।
বিশ্বজিৎ হরিজনের সংসার এভাবে চলতে থাকে। কিছুদিন ধরে তৃপ্তি বাঁশফোড় লক্ষ্য করছে তার স্বামী বিশ^জিৎ বাঁশফোড় যেন আগের থেকে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। সে কারো সাথে আগের মতো কথা বলে না। স্বাভাবিকভাবে খাওয়া দাওয়া করে না। বিশ্বজিৎ কে দেখে মনে হয় সে যেন কোন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছে। তৃপ্তি রাণী বারবার তাকে জিজ্ঞাসা করেও কোন উত্তর পেল না। বিশ^জিৎ যেন হঠাৎ করে সংসােেরর প্রতি সকল দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে যেন পরকালে নিয়ে ভাবছে। বিষয়টি তৃপ্তির কাছে একটু অন্যরকম মনে হলো। সে একদিন রাতে বিশ্বজিৎ কে জিজ্ঞাসা করে তোমার এমন কী হলো যে তুমি নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে রাখছো। বিশ্বজিৎ তাকে কিছুই বলতে চাই নি। তবে বিশ্বজিৎ নিজেকে সামলে রাখতে পারে না।সে তৃপ্তিকে বলে, আমি মারা গেলে আমার সন্তানদের কী হবে? তোমাকে কে দেখবে? তৃপ্তি বলে তুমি এমন কথা কেন বলছো? আমি সব সময়ে তোমার পাশে আছি। ছোট্টবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে তোমাকে আমি পেয়েছি। কোনদিন তুমি আমাকে অবহেলা কর নি। এখন কেন এমন কথা বলছো। ঈশ্বর যেন তোমার আগে আমাকে তুলে নেয়। বিশ্বজিৎ এবার তৃপ্তিকে বলে, ঈশ্বর সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা হলেও কিছু কাজ ঈশ্বরের ঈশারায় হয় না। মানুষ অনেক সময় ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে মানুষকে হত্যা করে যেখানে ঈশ্বরের কোন হাত থাকে না। আমি তোমাকে সব কথা খুলে বলি, তৃপ্তি তোমরা তো জানো সপ্তাহ খানেক আগের বাজারের পাশে খালে একটা মন্ডুকাটা লাশ পাওয়া গেছে। পুূলিশ এখন খুঁজছে কারা এই হত্যা কান্ড ঘটিয়েছে। যেদিন রাতে রতন প্যাটেল খুন হয়ে সেদিন খুব ভোরে আমি বাজারের উত্তর পাশের রাস্তা পরিষ্কার করছিলাম। হঠাৎ দেখি মন্ডল পাড়ার শিখর মন্ডল ও তার সাথে কয়েকজন লোক একটা বড় চটের বস্তা কাধে নিয়ে যাচ্ছে। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। আমি কোনরকম অনুমান করতে পারলাম তারা কোন একটা কিছু করেছে। আমি নিজেকে দোকানের আড়ালে লুকিয়ে ফেললাম। ভাবলাম আমি কিছুই দেখি নি। প্রায় আধাঘন্টা পরে শিখর তার দলবল নিয়ে বিশ্বজিৎ এর সামনে হাজির হলো। এবার বিশ্বজিৎ এর দম বন্ধ হয়ে গেল। সে কোন কথা বললে পারল না। শিখর শুধু তাকে একটা কথা বলে, যদি তুই কাউকে কিছু বলিস তবে তোর অবস্থা তো রতন এর মতো হবে আর তোর ছেলে বউয়ের অবস্থাও তোর মতো হবে। সেদিন থেকে প্রতিটি দিন আমাকে মৃত্যু তাড়া করে চলেছে। এই বুঝি শিখরের লোক এসে আমাকে খুন করে ফেলে। সেদিন আবার পুলিশ এসে হরিজন কলোনির সকলকে ডেকে বলেছে তোমাদের মাঝে কেউ কিছু জানলে আামদের বলো। না হলে আমরা যদি কোনভাবে জানতে পারি হরিজন কলোনীর কেউ এই হত্যাকান্ডের সাথে সাথে জড়িত থাকে তাহলে হরিজন কলোনীর সকল মেথরকে জেলে যেতে হবে। একদিকে পুলিশ অন্যদিকে শিখর মন্ডলের লোক এই বুঝি আমাকে শেষ করে ফেলে।
হরিজনদের কথা সমাজে কে বিশ্বাস করবে? আসল ঘটনা ঘটিয়েছে শিখর মন্ডলের লোকেরা। এখন আমি কী করব তৃপ্তি? আমারা যদি কলোনী ছেড়ে পালিয়ে যায় তাহলে এই কলোনীর সকলে ভাববে আমি খুনটার বিষয়ে জানি। আর যদি পুলিশকে খুনের বিষয়ে বলি তাহলে শিখরের লোকজন আমাদের খুন করবে। এখন আমি মৃত্যু ভয়ে প্রত্যেকটি দিন পার করছি। তৃপ্তি সব শুনে বিশ্বজিৎকে বলে, তুমি এমন ভাবে চলবে যেন সবাই বুঝতে পারে তুমি কিছু জানো না। এভাবেই তো দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু রতন মন্ডলের লোকেরা কম যায় না। একদিন রাতে রতন মন্ডলের লোকেরা বিশ^জিৎ এর কাছে আসে। রতন মন্ডলের ছোট ভাই রমেশ মন্ডল বিশ^জিৎকে বলে তুই জানিস কে দাদাকে খুন করেছে। যদি তুই আমাদের বলিস তাহলে তোর পরিচয় আমরা গোপন রাখবো। আর যদি তুই না বলিস আমারা তোকে মন্ডল দাদার কাছে পাঠাবো। রতন মন্ডলের রমেশ বিশ্বজিৎ এর সাথে দলবল নিয়ে দেখা করার খবর শিখর মন্ডলের কাছে পৌছে গেল। এবার তো শিখর মন্ডল আর নিজের রূপ ঢেকে রাখতে পারলো না। সেদিন রাতে বিশ্বজিৎ বাঁশফোড় নিজের কাজে বের হলো। কিন্তু সকাল বেলা রাস্তার পাশে গাড়ি চাপা অবস্থায় বিশ্বজিৎ বাঁশফোড় এর মৃতদেহ পাওয়া যায়। তৃপ্তি বাঁশফোর যখন স্বামীর মৃত্যুর খবর পেল সে বারবার মূর্ছা গেল। সে বারবার বলতে লাগলো, বিশ্বজিৎ কে খুন করা হয়েছে। কোন গাড়ি তাকে চাপা দেয় নি। কিন্তু কে শুনবে তৃপ্তির এই আহাজার। সে যে একজন হরিজন। সমাজের মোড়লদের আধিপত্য ধরে রাখতে বিশ^জিৎ এর মতো অনেক হরিজনকে জীবন দিতে হয়। কিন্তু সমাজের মানুষেরা জানতেও পারে না বিশ্বজিৎ এর হত্যার পেছনে কারা? হয়তো কোনদিন বিশ^জিৎদের হত্যার কারন সমাজের সামনে আসবে না। আর সমাজপতিরা বিশ্বজিৎ হত্যার কারন সামনে আসতে দিবে কেন? হরিজন কলোনির জীবন এভাবে চলতে থাকে বছরের পর বছর। একই ঘরে স্ত্রীপুত্র সন্তান সন্ততি নিয়ে। কেউ কেউ বিশ্বজিৎ এর মতো খুন হয় কিন্তু সেটাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে শিখর মন্ডলরা তো আছেই। অন্যদিকে শিখর মন্ডলেরা টিকে থাকে শত শত বছর। ইতিহাসে হরিজন কলোনীর গল্প সোনার হরফে নয় কান্নার নীল হরফে লেখা থাকে।