‘রূহ আফজা রাজ্জাক’ এর তিনটি কবিতা

‘রূহ আফজা রাজ্জাক’ এর তিনটি কবিতা

সংক্রমণ
রূহ আফজা রাজ্জাক

শীতের দীর্ঘ বিষন্ন রাতের আলো মেখে,
হোয়াংহো নদের একবুক হাহাকার চিরে,
জন্ম হয়েছিলো এক অন্ধকার ভাগাড়ে
সেইসকল যাযাবর জীবাণুদের!
পৃথিবীর প্রাচীন প্রাচিরের গা বেয়ে
নিঃশব্দে পৌছে যায় তারা
পৃথিবীর সব আধুনিক শহরে ,
বাঁদুরের ডানায় করে নিয়ে আসে
হীমশিতল নিস্তব্ধ রাত্রির মৃত্যুর ঝাপটা।

এক সাগর থেকে আরেক সাগরে
জটাধারী নাবিকের মত সুদক্ষ হাতে
নোঙর ফেলেছে তারা বন্দরে বন্দরে।
চেঙিসখানের রক্তপিপাসু সৈনিকের মত
ঢুকে পড়েছে শহরে শহরে।
তবে কেউ তাদের দেখেনি
শোনেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি
ভাবেনি তাদের ভয়াবহতা,
নির্মম নিষ্ঠুুর হতে পারে তারা কতটা।

কুয়াশামাখা শীতের জড়তা
কাটিয়ে যখন জীবনের স্বাদ
জেগে উঠবার কথা,
দল বেধেঁ যাবার কথা সূর্যস্নানে
বসন্ত উৎসবে মেতে উঠার কথা পার্কের
বেঞ্চি ছুঁয়ে কপোত কপোতীর,
শিশুদের বিস্ময়ে ছোটার কথা প্রজাপতির
মোহময় রঙীন ডানার পিছনে,
তখনি ছোবলে ছোবলে পূর্ণ হলো নীল পেয়ালাটা।

বিস্ময়ে কুয়াশার ঘোর না কাটতেই
ট্রাকে করে সারি সারি লাশের স্তুপ
শ্বেতশুভ্র বরফের উপর দিয়ে
চলে যায় রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে।
একদিন যেখানে ছিলো সুখের ফোয়ারা,
আজ সেখানে শুধুই ধুলির সাহারা।
কি এক ব্যাধি মহামারী রুপে
এলো শ্যামল ধরণীর বুকে।
ক্রন্দনের ধ্বনিতে নেচে উঠে কালনাগিনির ফণাটা।

ঘরে ঘরে আজ মৃত্যুর ছায়া
ভালোবাসাহীন দাফনের দায়,
মুখে ভারী মাস্কের আবরণ
আর জীবাণুর আলোরণ হৃদয় জুড়ে।
বন্ধ কপাটে কাঁচপোকার জীবন,
শিশুরা হারিয়েছে সকল শিহরণ।
তবু কি সেইসকল উম্মাদ জীবাণুরা
ধ্বংস হবেনা অভিশাপে কালের গহবরে
একবার কি ঘুম ভেঙে দেখবনা এক ভোর, পদ্মফোঁটা !

 

মেঘ বলেছে!
রূহ আফজা রাজ্জাক

হ্যাঁ আমিই মেঘ…
তোমরা চেনোনা আমায়?
আমিই সেই মেঘ। যখন ছোট্ট ছিলাম,
সাদা মেঘের পরী হয়ে ঘুরে বেড়াতাম
সারা আকাশময়,
বাতাস আমার নিত্য সঙী!
এলোমেলো দুষ্ট বাতাসে নিজেকে ভাসিয়ে দিতাম,
হারিয়ে যেতাম পাহাড়ের দেশে!
মায়াবী চাঁদের আলোয় ভিজে আমি একদিন
খুব বড় হলাম, একটু একটু করে ছুঁয়ে দেখলাম
সমুদ্র,নদী, ঝরণা, সবুজ বৃক্ষ, উদ্যান, ফসলের ক্ষেত
ওরা আমার জন্য উম্মুখ হয়ে থাকতো,
আমার ভালোবাসার স্পর্শে ওরা সজীব হতো!
আমার বয়ে চলা রুমঝুম শব্দে, আমার গানে
ওদের হৃদয়ে ভালোবাসার পেখম মেলতো।

তারপর একদিন সমুদ্রের লোনা জলের সাথে
নিজেকে মিশিয়ে সমর্পিত হলাম
এক ভালোবাসার রাজপুত্তুরের কাছে।
আমি মেঘ, আকাশ থেকে নেমে এলাম
মর্তলোকে, এলাম আমার গড়া স্বপ্নলোকে।
আমার স্বপ্নের আঙিনায় আমি আর আমার রাজপুত্তুর!
সারারাত জড়িয়ে থাকে আমাদের মহুয়ার গন্ধ
হালকা হালকা কুয়াশার চাদর উড়ে যায়
পৃথিবীকে মনে হয় স্বপ্নে মোড়া এক জাদুকর।
আমার দিনরাত্রির কাব্য রচিত হয় সীমাহীন মুগ্ধতায়!
আমি মেঘ, আমি তোমাদের সেই স্বপ্নের মেঘবালিকা।

একদিন আমার স্বপ্নের ঘরে বাতাস এলো অতিথি হয়ে,
আমার ছোট্টবেলার বন্ধু, আমার নিত্যসখা।
আমার হৃদয়ে এক হিল্লোল বয়ে গেলো।
বড় সাধ হলো পুরোনো দিনগুলোকে ছুঁয়ে দেখবার,
বললাম নিয়ে যাবে আমায় বাতাস,
সেই পাহাড়ের চূড়ায় কিংবা চাঁদের দেশে?
বলতেই বাতাস আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চলল দুর গগনে,
আমি ভাসছি, হাওয়ায় উড়ছি…..
এক অন্যরকম স্বর্গসুখে দোল খাচ্ছি।
আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমি মেঘ
হাওয়ায় হাওয়ায় যার শরীরে কাঁপন উঠে,
যে মুক্ত, যে স্বাধীন…..যে কোন বাঁধা মানেনা,
কোন মহুয়ার গন্ধে তার দিন কাটেনা, কুয়াশার চাদর তাকে ঢেকে রাখেনা,
দিনরাত্রি নিরন্তর ছুটে চলাই যার লক্ষ্য।
যার নিজের চলার পথ সে নিজেই রচনা করে
গান গেয়ে, রুমঝুম শব্দে,দেশ থেকে দেশান্তরে!

কিন্তু মেঘেরও যে একটা ছোট্ট ঘর ছিলো,
ছিলো এক ভালোবাসার রাজপুত্তুর!
ছিলো সীমাহীন মুগ্ধতায় ভরা স্বপ্নের আবেশ।
মেঘ কি ফিরে যাবে?
থেমে যাবে তার আপন চলার পথ?
মেঘের দুঃখ গাঢ় থেকে গাঢ় হয়ে
পুরো আকাশ ছেয়ে যায়।
সাদা মেঘের পরী বদলে যায় ঘন কালো মেঘে
কেউ চিনতে পারেনা তাকে,
সে আর ভাসেনা, চাঁদের সাথে দেয়না পাল্লা।
বাতাসেরও নেই সাধ্যি তাকে আর উড়িয়ে নেবার।
বাতাসও আজ বড় নিঝুম, নিস্তব্ধ!

হ্যাঁ আমিই সেই মেঘ,
আমি আর নই দ্বিধাহীন, শিকলবিহীন মেঘ,
আমি থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছি ঘন কালো মেঘ হয়ে,
একদিন অঝোরধারায় ঝরবো বলে!
একদিন ভীষণ প্লাবিত হবো রাজপুত্তুরের দেশে
ভীষণ গর্জনে গর্জনে আরেকবার ছুঁয়ে দেখবো
তোমাদের সাগর, নদী, ঝর্ণাধারা,অরণ্য….।
ভীষণ ডংকা বাজিয়ে, দশদিক ছাপিয়ে, বজ্রনিনাদে
বলবো আমিই তোমাদের ভালোবাসার মেঘ!
তোমাদের আকূল করা ভালোবাসায়
আবার বিলীন হবো তোমাদেরই আঁখি কোণে,
নবযৌবনে, নববিস্ময়ে, নবকুসুমকাননে…..

 

 

পত্র সিন্ধু
রূহ আফজা রাজ্জাক

আমাদের প্রেম ছিলো ভীষনই পত্রময়,
আর আমাদের পত্রগুলো ছিলো প্রেমময়।
পুজোর ফুলের মত পবিত্র ছিলো সেসব পত্র।
কিছু পত্র ছিলো গোলাপের মত সুগন্ধিযুক্ত
কিছু পত্র পদ্ম পাতার মত টলটলে,স্নিগ্ধ
কিছু আবার টগর বেলির মত শ্বেত শুভ্র
আবার কিছু পত্র সূর্যমূখীর মত উন্মুখ।
কত পত্র কত আঁখি পল্লবে এনে দিয়েছে
শত বিনিদ্র রাত্রির পর শিশিরস্নিগ্ধ ভোর।
কত পত্র সাত সাগর তের নদী পেরিয়ে এসে
বলতো দুর পাহাড়ের কথা ,জীবনের কথা,
বলতো বসন্ত উৎসবের কথা ,
ঘামে ভেজা শ্রমিকের বিপ্লবের কথা।
কত পত্র বুক পকেটে থেকেই শুকিয়ে গেছে
শরতের শিউলী ফুলের মত ,শুধু রেখে গেছে
হেমন্তের হালকা হলুদাভ স্মৃতি চিহ্ন।
কত পত্র বইয়ের পাতার ভাঁজে সযত্নে
লুকিয়ে থেকেছে ময়ূরপঙ্খী পালকের মত।
কিছু পত্র প্রাপকের কাছে পৌঁছবার আগেই
হারিয়ে যেত কালের গহীন অন্ধকারে।
পত্রপ্রাপ্তির স্বপ্ন নিয়েই চিরনিদ্রায়
চলে গেছে প্রতীক্ষারত প্রাপকেরা।
প্রেরকেরাও জানেনি কোনোদিন আর
তাদের হারিয়ে যাওয়া ছিন্নপত্রের কথা।
আবার কিছু কিছু পত্র ছিলো,
হিরোশিমা নাগাসাকির অ্যাটম বোমার
চেয়েও অনেক বেশি বিধ্বংসী।
কত শত হৃদয়ে একে দিয়েছে চিরক্ষত,
পাহাড়সম ব্যাথা নিয়ে তারা রচেছে
জীবনের যত অব্যাক্ত পত্র অবিরত।
শুকনো পাতার মতো,ঝরা পাতার মতো
হারিয়ে গেছে সেইসব মায়াবী পত্ররা ।
পত্রহীন পৃথিবী আজ পত্রহীন বৃক্ষের মতই
বড় প্রানহীন, নিঃস্ব , একাকী, প্রেমহীন।